Wednesday, 2 July 2025

জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

 জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

✍️ জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠিক প্রতিপন্ন হতে পারে। আবার কোনো এক সময়কার সঠিক সিদ্ধান্ত, ভবিষ্যতের আলোকে হতে পারে বিপর্যয়ের কারণ। অতএব, প্রশ্ন উঠে—জীবনের ভুল কি সত্যিই ভুল? নাকি তা সময়ের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে দেখব দার্শনিক চিন্তার আলোয়।
ভুলের সংজ্ঞা সময় ও প্রেক্ষিত অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। কোনো একটি কাজ বা সিদ্ধান্ত এক মুহূর্তে অসঙ্গত বা অনুচিত মনে হলেও, সময়ান্তরে তা হয়ে উঠতে পারে অনিবার্য বা সুফলপ্রদ।
বিশিষ্ট মার্কিন দার্শনিক উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন,
“Truth is what works.”
অর্থাৎ, যে কাজ বা সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়, সেটাই সত্য বা সঠিক। এর মানে দাঁড়ায়, যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে নতুন উপলব্ধি, শিক্ষা বা সাফল্যের দ্বার উন্মোচন করে, তবে তা কি সত্যিই ভুল?
জার্মান দার্শনিক হেগেল ইতিহাস ও ব্যক্তিজীবনের ভুল-সঠিককে সময়ের ডায়ালেকটিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর মতে,
“History is a rational process.”
তাঁর থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিনথিসিস ধারায় প্রতিটি ভুল সময়ের এক পর্বমাত্র, যা অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। জীবনের তথাকথিত ভুলগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন সত্যে রূপ নেয়। ভুল মানেই ব্যর্থতা নয়—তা এক বিকাশশীল প্রক্রিয়া।
ভারতীয় দার্শনিক শ্রীঅরবিন্দ মনে করেন, আত্মার বিকাশে ‘ভুল’ এক অপরিহার্য ধাপ।
“Every fall is a step towards the rise.”
অর্থাৎ, প্রতিটি পতনই এক উত্থানের পূর্বশর্ত। সময়ের দৃষ্টিতে যা ভুল বলে মনে হয়, তা হয়ত সেই সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় এক অন্তর্জাগরণের মাধ্যম। কিছু অভিজ্ঞতা কেবল সময়ের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তার তাৎপর্য।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ-পল সার্ত্র বলেন,
“Man is nothing else but what he makes of himself.”
তাঁর মতে, ভুল করা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গ। সময়ের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের গড়ে তুলি—ভুল-সঠিকের মধ্য দিয়ে। যে কাজ এক সময় ভুল মনে হয়েছিল, ভবিষ্যতে হয়তো সেটাই নিজেকে গড়ার প্রধান উপাদান হয়। সার্ত্র এখানে সময়কে ‘চরিত্র নির্মাণের আয়না’ হিসেবে দেখেন।
কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ সমকালে নিন্দিত হলেও, সময়ান্তরে তা নায়কোচিত হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, গ্যালিলিও যখন বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, তখন তাঁকে 'ভুল' বলে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে আজ তাঁর কথাই বিজ্ঞানের সত্য।
এই বাস্তবতা হেগেলের বক্তব্যকে আরও জোরালো করে তোলে—
“The owl of Minerva flies only at dusk.”
বোধির পাখি সন্ধ্যাবেলায় উড়ে—অর্থাৎ, আমরা কোনো ঘটনার মর্ম সময় পেরিয়ে গেলে বুঝি।
উপনিষদীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ভুল আসলে 'অবিদ্যা'—যার মাধ্যমে আত্মা নিজেকে আবিষ্কারের পথে এগোয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—
“কর্মই তে অধিকার....।”
আমরা কাজ করি, ফল বা তার গ্রহণযোগ্যতা সময় নির্ধারণ করে। কাজের ফল কখনো তাৎক্ষণিক না-ও হতে পারে, কিন্তু তা মূল্যবান অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে ভবিষ্যতের জন্য।
তাহলে জীবনের ভুল কি সত্যিই ভুল? দর্শনের আলোকে বলা যায়—ভুল এক আপেক্ষিক ও সময়-নির্ভর মানসিক গঠন। ভুল মানে বিপর্যয় নয়, তা এক উপলব্ধি, আত্ম-উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতি।
সময়ই শেষ বিচারক।
© রূপেশ কুমার সামন্ত
আপনাদের সুচিন্তিত মতামত কামনা করি।

জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

  জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল? জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠি...