২৫
শে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্ম-জয়ন্তীতে শ্রদ্ধার্ঘ…
-----চলো যাই শান্তিনিকেতনের তরুবীথি তলে-----
ছবি ও লেখা -শ্রী রূপেশ কুমার সামন্ত/
০৬.০৫.১৮
আসলে
পরিকল্পনা করে সব কিছু হয় না। ইচ্ছে হল, বেরিয়ে পড়ি। ব্যাস! একটা শুধু রুকস্যাক
ব্যাগ। সকাল সকাল হাওড়ায় ট্রেনে চেপে পড়া। মাত্র ১৫০ কিলোমিটারের মতো পথ। সময় লাগে
আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। প্রচুর ট্রেন রয়েছে। বোলপুর স্টেশনে নেমে টোটো বা রিক্সায়
চেপে শান্তি নিকেতন। তারপর সেই ইতিহাসের হাতছানি। জীবনকে ছাপিয়ে যাওয়া
রবীন্দ্রনাথ…
-----ফিরে দেখা----
বীরভূম
জেলার বোলপুরের শান্তি নিকেতন অঞ্চলটি একসময় জমিদার ভুবন সিংহের নামানুসারে
ভুবনডাঙ্গা নামে পরিচিত ছিলো। অন্য মতও শোনা যায় (তবে সত্যতা যাচাই করা হয়নি), কুখ্যাত ভুবন ডাকাতের নামেই এই অঞ্চলের নাম
হয় ভুবন ডাঙা। যাইহোক, রায়পুরের জমিদার পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ আত্মীয়তা ছিলো। ১৮৬২ সালে মহর্ষি জমিদারবাড়িতে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে যাচ্ছিলেন। রায়পুরের
পথে যেতে যেতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লাল মাটির এই অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য দেখতে পান।
দিগন্ত বিস্তৃত চোখ জোড়ানো সবুজ ধান ক্ষেত। দেখেই হৃদয় জুড়িয়ে যায় তাঁর। এই জায়গাই
ঈশ্বরের উপযুক্ত আরাধনাস্থল ভেবে তিনি রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে জমিটি কেনার
আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জমিদার রাজী হওয়ায় জমিটি কিনে নেন। তার পর তিনি সেখানে বাড়ি
তৈরি করেন। সেই বাড়িটির নাম দেন শান্তিনিকেতন। ১৮৬৩ সালে তিনি সেখানে একটি আশ্রম
তৈরি করেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রপাত করেন।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ১৯০১
সালে
ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। তাঁর
সাহিত্য ও
সৃষ্টিকর্মে এই
আশ্রম
অনন্যতা লাভ করে। ১৯৫১
সালে
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের
কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ
করে।
-----শান্তিনিকেতন
ভবন-----
গেটদিয়ে ঢুকেই প্রথম দর্শনীয় স্থান হল
শান্তিনিকেতন ভবন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮৬৪
সালে
এই
বাড়িটি তৈরি
করেছিলেন। এটি প্রথমে একতলা
বাড়ি
ছিল।
পরে
দোতলা
হয়।
মহর্ষি
বাড়ির
একতলায় বসে ধ্যানে
বসতেন।
ছোটবেলায় বাবার
সঙ্গে
হিমালয়ে যাওয়ার পথে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এখানে
কিছুদিন ছিলেন।
ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও
রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন এখানে বাস করেন।
পরে
আর
কখনও
তিনি
এটিকে
বসতবাড়ি হিসেবে
ব্যবহার করেননি। এই
বাড়ির
সামনে
রামকিঙ্কর বেইজ
এর
একটি
বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। এই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটি
টিলার
মতো
মাটির
ঢিবি
থেকে মহর্ষি সূর্যোদয় ও
সূর্যাস্ত দেখতেন। বাড়ির
উপর একটি উপনিষদের উক্তি লেখা রয়েছে- ‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং ’।
-----উপাসনা
মন্দির-----
এরপর পাশেই রয়েছে উপাসনা মন্দির। ১৮৯২
সালে উপাসনা গৃহ বা
ব্রাহ্ম মন্দিরের উদবোধনী হয়। এই
মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন
মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র
দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মন্দির
গৃহটি
রঙ্গিন বেলজিয়াম কাঁচ দিয়ে
নির্মিত। অপূর্ব সুন্দর দেখতে এই মন্দির। প্রতি বুধবার
সকালে এখানে উপাসনা হয়।
-----ছাতিমতলা----
এরপর চলুন ছাতিমতলা। একবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রায়পুরের জমিদারবাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে এই
ছাতিমতলায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন।
জায়গাটি তার খুব ভালো লেগেছিল। তখন রায়পুরের জমিদারের কাছ
থেকে
এক টাকার (তখন ষোল আনা) বিনিময়ে ২০বিঘা
জমি
কিনে নেন। কিন্তু সেই
ছাতিম
গাছ
দুটি
মরে
গেছে।
তারপর
ঐ
জায়গায় দুটি
ছাতিম
বৃক্ষ
রোপণ
করা
হয়েছে।
সেই
ছাতিম
তলা
বর্তমানে সকলের
প্রবেশ
নিশেধ।
মহর্ষি এখানে তার
প্রাণের আরাম,
মনের
আনন্দ
ও
আত্মার
শান্তি
পেয়েছিলেন বলে গেটে “তিনি
আমার
প্রাণের আরাম,
মনের
আনন্দ
ও
আত্মার
শান্তি”
কথাটি
লেখা
রয়েছ।
-----তালধ্বজ-----
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে
দারুন সুন্দর গোলাকৃতির এক
মাটির
বাড়ি। তেজশচন্দ্র সেন
এই
বাড়িটির নির্মাতা। এই বাড়িটি শান্তিনিকেতন আশ্রমের সৌন্দর্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। একটি
তালগাছকে কেন্দ্র করে
এই
বাড়িটি
নির্মিত হয়েছে। তালগাছটি দণ্ডায়মান পতাকা বা 'ধ্বজা'র মত দাঁড়িয়ে আছে বলেই
এর
নাম
"তালধ্বজ"।
-----তিনপাহাড়----
তারপর ‘তিনপাহাড়’। তিনপাহাড়ের কথা
আমরা রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার আত্মকথা থেকে পাই। পাথর কুড়িয়ে বট গাছের নিচে ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ
পাহাড় বানান। এই বটবৃক্ষটি এখন বাঁধান হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথের
ধ্যানস্থল
এটি।
-----দেহলী-----
এটি
একটি ছোট দোতলা বাড়ি। নাম ‘দেহলি’। ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে এই বাড়িটির প্রতিষ্ঠা। স্ত্রীর মৃণালীনি দেবীর মৃত্যুর পর কবি একাকী দীর্ঘদিন এই বাড়িতে ছিলেন। এখানে তিনি অনেক সাহিত্য সৃষ্টি করেন।
বর্তমানে দেহলিতে রয়েছে শিশুদের বিদ্যালয় ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’। কবিপত্নীর স্মরণে ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে
এই শিশু বিদ্যালয়ের সূচনা হয়।
----নতুন বাড়ি-----
শালবীথি
থেকে পায়ে পায়ে পূর্বদিকে এগিয়ে
গেলে খড়ের চালের বাড়ি ‘নূতন-বাড়ি’ দেখতে পাব। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শান্তিনিকেতন’
বাড়িটি আশ্রমের অতিথিদের জন্য তৈরি করেছিলেন। ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে
রবীন্দ্রনাথ সস্ত্রীক পুত্রকন্যাসহ
থাকবেন বলে এই বাড়িটি করেন।
কিন্তু বড়িটি সম্পূর্ণভাবে নির্মিত হওয়ার আগেই মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। কবির পুত্র-কন্যারা এই বাড়িতে ছিলেন। সন্তানেরা তাদের এক দূরসম্পর্কীয় দিদিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে এখানে বসবাস করতেন। বর্তমানে এটি ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি’র কার্যালয়।
-----শালবীথি-----
-----শালবীথি-----
দেহলী বাড়ির সামনে দিয়ে লাল মাটির একটি রাস্তা চৈতির দিকে বিস্তৃত রয়েছে। এই পথ কবির খুবই প্রিয় পথ। এই রাস্তার ধারে সার দিয়ে অসংখ্য
শালগাছ রয়েছে। কবি এই স্থানটির নাম দেন ‘শালবীথি।
-----আম্রকুঞ্জ-----
উপাসনা মন্দির আর শালবীথির মাঝখানে রয়েছে ‘আম্রকুঞ্জ’। এখানে আকাশের নীচে আম গাছের তলায় বিদ্যালয়ের ক্লাস হয়। গাছতলায়
চাতাল করা রয়েছে। বেদিতে শিক্ষকরা বসে পড়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানও হয় এখানে। এখানেই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা দিবস পালন, রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবর্ধনাজ্ঞাপন, বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছে। এখনও ভারতের প্রধান মন্ত্রী তথা বিশ্বভারতীর আচার্যের
উপস্থিতিতে এখানে সমাবর্তন উৎসব পালিত হয়।
-----সন্তোষালয়-----
টালির ছাদওয়ালা বাড়িটি ‘সন্তোষালয়’। প্রথমে বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখানে থাকত। এটি বর্তমানে শিশুদের হোস্টেল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের
সঙ্গে বন্ধুর পুত্র
সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা পাঠের জন্য পাঠান। আমেরিকা থেকে ফিরে তিনি শ্রীনিকেতনের কাজে মন দেন। তাঁর অকাল-মৃত্যুতে স্মৃতির উদ্যেশে
এই গৃহটির নামকরণ হয় ‘সন্তোষালয়।
-----ঘণ্টাতলা-----
শালবীথির মাঝামাঝি স্থানে গৌরপ্রাঙ্গণে
বটগাছের নীচে ‘ঘন্টাতলা’। প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপের
বা
সাঁচিস্তুপের আদলে এটি তৈরি। এই ঘন্টাধ্বনি
অনুসারে ক্লাস হয়।
-----শমীন্দ্র শিশু
পাঠাগার-----
পাঠভবনের পূর্বদিকে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার
‘শমীদ্র শিশু পাঠাগার’। রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে এর নামকরণ হয়।
-----গৌরপ্রাঙ্গন-----
সিংহসদনের
সামনে বিরাট মনোরম মাঠই হল গৌরপ্রাঙ্গন। শান্তিনিকেতনের ছাত্র গৌরগোপাল ঘোষ ছিলেন বিশিষ্ট
খেলোয়াড়। সেই গৌরগোপাল ঘোষের নামে এই মাঠের নাম করণ করা হয়েছে।
-----সিংহসদন-----
গৌরপ্রাঙ্গণের দক্ষিণে অবস্থিত দর্শনীয় ‘সিংহসদন’। দ্বিতল এই বাড়ির এক পাশে ছাদে রয়েছে ঝুলন্ত ঘণ্টা আর
অন্যটায় উঁচু চূড়ায় তিন পাশে তিনটি ঘড়ি। ঘণ্টার সাংকেতিক ধ্বনি শুনে ছাত্র-ছাত্রীরা বুঝতে পারে কখন কী অনুষ্ঠান হবে। রায়পুরের জমিদার লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের অর্থায়নে এই বাড়ি তৈরি হয়। তাই এর নাম ‘সিংহসদন’। ১৯৪০
খ্রীষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট এই বাড়িতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে
ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করেন।
-----পূর্ব ও পশ্চিম তোরণ-----
পাশেই রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম তোরন।
-----দিনান্তিকা-----
১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে দিনেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের পত্নী কমলাদেবী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। বেণুকুঞ্জের পাশে আটটি কোণ আকৃতির ছোট দোতলা বাড়িটি ‘দিনান্তিকা’। দিনের শেষে আশ্রমের ক্লান্ত শিক্ষক ও কর্মচারীবৃন্দ
এখানে বিকেলের চা-জলখাবারের আসরে আসতেন।
-----চৈতি-----
চৈতি একটি
কুঁড়েঘর। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার রাস্তার সংযোগস্থলে একটি বেল গাছের নীচে চৈতিগৃহ অবস্থিত। এর ছাদটিও মাটির। মাটি ও আলকাতরার সংমিশ্রণে একটি স্থাপত্য। নির্মান করে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কর ও নন্দলাল বসু। চৈতিতে মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের নতুন সৃষ্ট শিল্পসামগ্রী পালা করে এখানে প্রদর্শিত হয়।
-----দ্বিজবিরাম----
শান্তিনিকেতেনের
দক্ষিণ দিকের প্রথম ফটকের কাছে টালির ছাদের বাড়ি ‘দ্বিজবিরাম’। রবীন্দ্রনাথের
বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষ বছরগুলি এই বাড়িতে কাটিয়েছেন। বাড়িটির নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
----কালোবাড়ি----
সংগীতভবনের পাশে কলাভবনের ছাত্রাবাসের নাম ‘কালোবাড়ি’। এটি মাটির বাড়ি এবং অ্যাসবেস্টস্ চালের। বাড়ির
দেওয়ালগুলি ভাস্কর্যে মণ্ডিত। এই ভাষ্কর্যগুলি
বৃষ্টির জল থেকে রক্ষার
জন্য এগুলির উপর নিয়মিত আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়।
-----পাঠভবন দপ্তর-----
গৌরপ্রাঙ্গণের কাছে পাঠভবন দপ্তর অবস্থিত। প্রথমে এই বাড়িতে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার।
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর তাঁর ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করেন।
-----হিন্দিভবন-----
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনের
পাশে দো’তলা বাড়ি ‘হিন্দিভবন’। এখানে হিন্দি সাহিত্যের উপর চর্চার জন্য একটি গ্রন্থাগার আছে।
-----চীনাভবন-----
হিন্দিভবনের পাশে রয়েছে ‘চীনাভবন’। চীনাভবনের গ্রন্থাগারটিতে চীনা সাহিত্য ও বৌদ্ধশাস্ত্রের নানান দুস্প্রাপ্য পুঁথি আছে। চীনাভাষায়
উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত পড়াশুনা ও গবেষণা করার ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। অধ্যাপক
তান-য়ুন-শানের প্রচেষ্টায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
-----মুকুটঘর-----
প্রাক্তন শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ছাত্ররা চীনাভবনের সামনে খড়ের চালের ছোট বাড়িটি একটি বাড়িটি তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ নাটকটি এখানে প্রথম অভিনীত হয়। তাই এই বাড়ির নামকরণ হয়েছিল ‘মুকুটঘর’।
-----কলাভবন-----
শ্রীনিকেতনের দিকে যেতে রাস্তার ধারে কলাভবন। কলাভবনের পুরানো নাম ছিল ‘নন্দন’। তখন ছিল
পুরানো বাড়ি। নতুন বাড়িটির নাম হল ‘নবনন্দন’। এখানে সংগ্রশালা, গ্রন্থাগার ও অফিস রয়েছে। সংগ্রহশালায় বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের সংগ্রহ আছে।
-----সঙ্গীতভবন-----
কলাবভবনের পাশে দোতলা বাড়িটি ‘সঙ্গীতভবন’। সংগীত চর্চার জন্য বিখ্যাত এই সংগীতভবন।
-----নাট্যঘর-----
-----নাট্যঘর-----
রবীন্দ্রভবনের পাশে বিরাট হলঘরটি হল নাট্যঘর। নাট্যচর্চা
ও নানান অনুষ্ঠান হয় এখানে।
-----কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার-----
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল অফিসের সামনে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগার ছাড়াও বিভাগীয় গ্রন্থাগার আছে। যেমন রবীন্দ্রভবন, কলাভবন, শিক্ষাভবন, পাঠভবন, শিক্ষাসত্র, পল্লীশিক্ষাভবন,
পল্লীসংগঠন বিভাগ, হিন্দিভবন, চীনাভবন, বিনয়ভবন, দর্শনভবন
এবং সংগীতভবন। এই গ্রন্থাগার গুলিতে
মোট বই ছয় লক্ষেরও বেশি।
-----নিপ্পনভবন-----
-----নিপ্পনভবন-----
জাপানী-সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হল নিপ্পন ভবন। ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি নিপ্পনভবনের
দ্বারোদঘাটন করেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি
কে. আর. ইারায়ন। রবীন্দ্রনাথের
জাপানী সংস্কৃতির প্রতি প্রবল আগ্রহের করনেই এই কেন্দ্র। ১৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দ
থেকে এই ভবন প্রকাশ করে চলেছে ভারত-জাপান সাহিত্য-সংস্কৃতি-মৈত্রী সম্পর্কিত পত্রিকা ‘তোসামারু’। এখানে জাপানী ভাষা ও সাহিত্যের উপর একটি গ্রন্থাগারও
আছে।
----উত্তরায়ণ প্রাঙ্গন-----
শান্তিনিকেতনের আশ্রমের উত্তরদিকে অবস্থিত একটি এলাকাকে ‘উত্তরায়ন’ বলে। মূলত পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে উত্তরায়ণ। বাড়ি পাঁচটি হলো- কোনার্ক, উদয়ন, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী। এছাড়াও এখানে রয়েছে চিত্রভানু-গুহাঘর এবং বিচিত্রা বাড়ি।
----কোনার্ক-----
উত্তরায়ণের শিমূল গাছের পাশে বাড়িটির নাম ‘কোনার্ক’। উত্তরায়ণ এলাকার মধ্যে প্রথম দু’টি পর্ণকুটির তৈরী হয়েছিল। তারই একটি পরিবর্তিত হয়ে তৈরি হয় ‘কোনার্ক’ বাড়ি। প্রথমে ছিল খড়ের চাল। পরে পাকা করা হয়। ‘কোনার্ক’ বাড়ির ঘরগুলি কোনোটির মেঝে উঁচু, আবার কোনোটির মেঝে নিচু।
-----উদয়ন-----
এই
বাড়িটি
নানা সময়ে নানা ভেঙে গড়ে আজকের রূপ পেয়েছে ‘উদয়ন’। বাড়িটির ভিতরে কাঠের কারুকাজ করা। চারিদিকে বসার জায়গা এবং
মাঝখানে
ফাঁকা। শীতলপাটি দিয়ে ভিতরের দেওয়ালগুলি ঢাকা আছে। ঘরের ভিতরের
নক্সা কবিগুরুর নিজের সৃষ্ট। এই বাড়ির বারান্দায়
কবির শেষ জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে
২৫শে জুলাই এই বাড়ি থেকেই রবীন্দ্রনাথ
কলকাতায় চিকিৎসার জন্য শেষবারের মতো চলে যান। এই বাড়িতেই
প্রথম রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা প্রথমে গড়ে ওঠে।
-----শ্যামলী-----
উত্তরায়নের কোনার্কের পূর্বদিকে মাটির বাড়িটি ‘শ্যামলী। একই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের থাকতে কখনোই ভালো লাগতো না।
তাই এই বাড়ি নির্মান। বাড়ির দেওয়াল ও ছাদ মাটির। কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা
শ্যামলীর দেওয়ালে মূর্তি বহু মূর্তি গড়েছে। প্রবেশ পথের দু’পাশে রামকিঙ্কর বেজের তৈরি অসামান্য কীর্তি ‘সাঁওতাল-সাঁওতালনী’ স্থাপত্য রয়েছে। গান্ধীজী, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, বিনোবা ভাবে, মাদার টেরেজা সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই বাড়িতে থেকেছেন।
-----পুনশ্চ-----
কবির ইচ্ছাতেই শ্যামলীর পূর্বদিকে ‘পুনশ্চ’ বাড়িটি গড়ে ওঠে। এই বাড়ির দেওয়াল মাটির এবং ছাদ কংক্রিটের। মাঝখানে একখানি ঘর এবং চারিদিকে খোলা বারান্দা। পরে বারান্দাটি কাঁচ দিয়ে ঘেরা হয়। শ্যামলীকে
কবি বলেছিলেন তাঁর
জীবনের শেষ বাড়ি। কিন্তু পুনরায় এই বাড়ি তৈরি হলো বলে এই বাড়ির নাম রাখা হল ‘পুনশ্চ’।
-----উদীচী-----
পুনশ্চের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের দোতালা বাড়িটি হল ‘উদীচী’। পুনশ্চতেও কবি বেশিদিন থাকতে পারলেন না। আবার তৈরি করলেন উদীচী। এটাই কবির শেষ বাড়ি। প্রথমে এই বাড়ির নামকরন হয় ‘সেঁজুতি’, পরে উত্তর দিকের বাড়ি বলে নামকরন হয় ‘উদীচী’। দোতালা
একটি ঘর ও সঙ্গে রয়েছে একটি বারান্দা। বাড়ির পাশে রথীন্দ্রনাথের
তৈরি গোলাপ বাগান রয়েছে।
-----চিত্রভানু-গুহাঘর-----
উত্তরায়ণের দক্ষিণে রয়েছে ‘চিত্রভানু-গুহাঘর’। বাড়িটির দোতালার নাম ‘চিত্রভানু’ ও
নিচের অংশের নাম ‘গুহাঘর’। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর স্টুডিও ছিল চিত্রভানু এবং গুহাঘরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের
কর্মশালা।
‘গুহাঘরে’র বাইরেটা দেখতে গুহার মতো, আর ভিতরেরটা দেখতে ছিল জাহাজের কেবিনের
মতো।
-----বিচিত্রা (রবীন্দ্রভবন) -----
-----বিচিত্রা (রবীন্দ্রভবন) -----
উত্তরায়ণের প্রবেশ পথের পাশে দোতলা বাড়িটি ‘বিচিত্রা’। এখানে
রবীন্দ্র-সংগ্রহশালা রয়েছে। এই বাড়ি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম-শতবর্ষে তৈরী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপি,
চিঠিপত্র, নোবেল মেডেল (প্রতিরূপ রয়েছে, আসলটি চুরি হয়ে গেছে), দলিলপত্র, রবীন্দ্রনাথ ও নানান শিল্পীদের আঁকা ছবি, উপহার সামগ্রী, রবীন্দ্রনাথের
পোষাক ও তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী এবং কবির বহু ছবি রয়েছে এখানে।
এখানে রয়েছে প্রদর্শনকক্ষ,
সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, রবীন্দ্র-চর্চা প্রকল্প, মাল্টিমিডিয়া প্রকল্প, অডিয়ো-ভিজ্যুয়াল বিভাগ, সংরক্ষণ বিভাগ। গ্রন্থাগারে আছে রবীন্দ্রনাথের
ব্যবহৃত বই, নিজের লেখা বই এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা বিভিন্ন লেখকের বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য শিল্পীদের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত
ও রবীন্দ্র-কবিতার ক্যাসেট-ডিস্ক রয়েছে এখানে।
নানান পত্রিকা, সংবাদপত্রের বাছাই অংশ এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুবাদ। তাঁর
সম্পর্কে তথ্যচিত্র এবং তাঁর গল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্র সমূহ রয়েছে এখানে।
-----পাশাপাশি-----
শান্তিনিকেতন
ঘোরার পর পাশাপাশি দর্শনীয় স্থানগুলি দেখতে ভুলবেন না। অবশ্যই ঘুরে দেখতে হবে-
১.
বল্লভপুর অভয়ারণ্য ডিয়ার পার্ক। ২. কোপাই নদীর ধারে অবস্থিত অন্যতম একান্ন পীঠস্থান কংকালীতলা। বিশ্বাস মতে,
কুন্ডের জলের মধ্যে রয়েছে সতীর দেহাংশ। এখানে সতীর কাঁকাল বা কোমর পড়েছিল। ৩. প্রায় ৩০ কিমি
দূরে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের জন্মস্থান লাভপুর। ৪. এছাড়া শ্রীনিকেতনের কাছে সিউড়িগামী পাকা রাস্তার পাশে রয়েছে কুটিরশিল্প কেন্দ্র ‘আমার-কুটির’। এখানে শোলা, বাটিক, চামড়া, গালা, তাঁত, সূঁচিশিল্প সহ নানান হাতের কাজ হয়। ৫. হাতের কাজ করা কাঁধে ঝুলানো চমৎকার ব্যাগের দোকান। ৬. হস্ত শিল্প
সামগ্রীর জন্য বিখ্যাত হাট খোয়াই এর দেখতে ভুলবেন না।
ছবি ও লেখা- শ্রী রূপেশ কুমার সামন্ত/
০৬.০৫.১৮
No comments:
Post a Comment