পঞ্চমুণ্ডির আসনের সামনে পূজিতা হন আলুগ্রামের ৩০০ বছরের প্রাচীন কালী



পঞ্চমুণ্ডির আসনের সামনে পূজিতা হন আলুগ্রামের ৩০০ বছরের প্রাচীন কালী
-রূপেশ কুমার সামন্ত, শিক্ষক

     ‘এক ব্যক্তির হাতে পায়ে লোহার শিকল দিয়ে বেড়ি পরানো। বীভৎস তার রূপ। তার হিংস্র আচরণে মানুষ সন্ত্রস্ত। তাকে এনে রাখা হল কালী মায়ের সামনে। ব্রাহ্মণ পরিয়ে দিলেন মন্ত্রপুত বালা। ধীরে শান্ত হয়ে গেল সেই উন্মাদ।’ এই কথাগুলি বলছিলেন উষৎপুর সৌদামিনী বিদ্যামন্দিরের (উ.মা.) শিক্ষক ও পাঁশকুড়ার হাউর গ্রাম পঞ্চায়েতের আলুগ্রামের বাসিন্দা অতনু ব্যানার্জী। তিনি আরও বলছিলেন, ‘আমাদেরকেও অবাক করে এই অলৌকিক ঘটনা। অসংখ্য পাগলকে এই দেবালয়ে নিজের চোখেই সুস্থ হতে দেখেছি’। মনস্কামনা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এখানে জড়ো হয়। তাঁদের এই বিপুল সমাগমই এলাকাবাসীদের বিশ্বাসের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা সহ বিভিন্ন রাজ্যের ভক্তবৃন্দ প্রতি শনি ও মঙ্গলবার পূজার ডালি নিয়ে হাজির হন পাঁশকুড়ার আলুগ্রামের এই শ্মশানকালী মন্দিরে।

ইতিহাসের পথ ধরে
     সে প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। আলুগ্রামের এই এলাকাটি ছিল জল-জঙ্গলে পূর্ণ। বর্তমান দেবালয়ের স্থানেই ছিল ব্রাহ্মণদের শ্মশান। তৎকালীন সময়ে অজানা জ্বরে বহু মানুষের মৃত্যু হতে থাকলো। মৃত্যুর জেরে গ্রাম প্রায় উজাড় হয়ে গেল। আলুগ্রামের বাসিন্দা তথা কুমরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অরুন ব্যানার্জী জানালেন, ‘তৎকালীন সময়ে রোগের কারনে গ্রাম প্রায় মানুষ শুন্য হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে এই গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দাই বাইরে থেকে আগত, এখানকার আদি বাসিন্দা নয়।’ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য গ্রামের সন্ধ্যা রানী ভট্টাচার্যের পূর্বপুরুষরা উপায় খুঁজছিলেন। এমন সময় গ্রামে হাজির হলেন এক কাপালিক। তিনি তাঁর সাধনার জন্য একটি ব্রাহ্মণ শ্মশানের খোঁজ করছিলেন। মানুষের রোগ মুক্তির জন্য তাঁকে এই ব্রাহ্মণ শ্মশানে সাধনা করতে অনুমতি দান করা হল। তিনিই এই শ্মশানে শুরু করলেন শ্মশান কালীর পূজা। তার পর থেকেই গোটা গ্রাম নাকি রোগ মুক্ত হয়েছিল। সেই থেকেই এই গ্রামে আজও চলছে এই শ্মশান কালীর পূজা।

পঞ্চমুণ্ডির আসন
     দেবী মূর্তির সামনে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেই কাপালিক সাধনার জন্য শ্মশানের উপর বটবৃক্ষ তলে নির্মান করেছিলেন এই পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেই বটবৃক্ষ আজও রয়েছে। এই পঞ্চমুণ্ডি আসনের নিচে রয়েছে পাঁচটি জীবের মুণ্ড বা মাথা। সবই স্ত্রী প্রজাতির। একটি নিচু সম্প্রদায়ের আত্মঘাতী মহিলার মাথা, একটি ‘কালনাগিনী’ সাপের মাথা, দু’টো স্ত্রী পেঁচার মাথা, একটি স্ত্রী শেয়ালের মাথা দিয়ে নির্মিত এই পঞ্চমুণ্ডির আসন। এই আসনে বসেই নাকি সেই কাপালিক মোক্ষলাভ করেছিলেন। প্রথা অনুসারে আজও এই আসনে বসে ব্রাহ্মণ পূজা করেন। এখানে প্রতিবছর প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি ছাগল বলি দেওয়া হয়।

মেলা ও অনুষ্ঠান
     পূজা উপলক্ষ্যে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। মেলা বসে। মেলায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়াও নানান মুখরোচক খাবার বিক্রী হয়। নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পূজার পরের দিনও মেলা-অনুষ্ঠান চলে। বিশেষ আকর্ষণের বিষয় হল- মন্দিরের সামনে রয়েছে প্রায় ৩০ফুট উচ্চতার এক সুউচ্চ শিবের পূর্ণাবয়ব মূর্তি।

পরিচালনা
     পূজাটি গ্রামীন হলেও একটি কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা হলেন মৃণাল ব্যানর্জী। কমিটিতে রয়েছেন অরুন ব্যানার্জী, হরেকৃষ্ণ জানা, বীরেন গাঁতাইত, বিশ্বজীৎমান্না, কালিপদ নায়েক, বানেশ্বর সামন্ত, রামকৃষ্ণ দাস, নারায়ন জানা ও নিমাই সামন্ত।

পথনির্দেশ
     দক্ষিন-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর শাখায় হাউর ষ্টেশনে নামতে হবে। হাউর ষ্টেশন থেকে দক্ষিনপূর্ব দিকে ২.৫ কি.মি. রাস্তা। যানবাহন হিসাবে টোটো রয়েছে।

বিস্তারিত- এখানে লেখা ও বিবিরণ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আলুগ্রামের এই শ্মশানকালী সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ পাবেন আগামী ১লা নভেম্বর পাঁশকুড়া থেকে প্রকাশিত ‘সংবাদ আশার দিশারী’ পত্রিকায়।

Comments

Popular posts from this blog

Essay [রচনা]- মাহে রমযান

250 YEARS OLD BEGUNBARI KALI PUJA, PANSKURA, WB, INDIA

----- HISTORY OF PANSKURA [WB, INDIA] [PART-1] -----