Popular Posts

Monday 14 June 2021

ওরা ‘হো’রা- ভালো নেই ওরা! Tribal Ho

 

ওরা ‘হো’রা- ভালো নেই ওরা!

© রূপেশ সামন্ত

 
















     ‘কেমন আছেন?’ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এক বিধবা রমনীকে। তিনি মালতী সিরকার। বয়স বড়জোর তিরিশ। মুখ নিচু করে মাটির দালানে বসেছিল মালতী। মুখে কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে এগিয়ে এলেন গুরুপদ বাবু। পুরো নাম গুরুপদ পূর্তি। আদিবাসী হো সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক। তিনি জানালেন, ‘মালতীর স্বামীর মাদকাসক্ত হয়ে মারা গেছে খুব অল্প বয়সে’। তিনি আরও জানালেন, ‘এখানকার অল্প বয়সী বহু যুবক মদ খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। গতবছর আমাদের ক্লাবের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২০টি মদের ভাটি ভাঙা হয়েছে। তবুও রোখা যায়নি এই সর্বনাশা নেশা’। শুধু মিতালী সিরকার নয়, সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল মালতী সিরকার। বয়স বড়জোর পঁয়ত্রিশ। সেও স্বামীহারা। তার পোষাকে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। এমন অনেক মিতালী-মালতীরা আজ সন্তান-সন্ততি নিয়ে অসহায়!

     ‘কোন ক্লাসে পড়াশোনা করো তুমি?’ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম একটি শিশুকে। সে রূপকুমার মাণ্ডি। বয়স বড়জোর আট বছর। অন্যান্য শিশুদের সাথে ‘পাতালুকানি’ খেলছিল। আমার প্রশ্নে তার মুখটা শুকিয়ে গেল। এমন সময় এগিয়ে এলো স্নেহাশিষ। পুরো নাম স্নেহাশিষ হেমরম। এখানকার চরম অশিক্ষার অন্ধকারের মাঝে স্নেহাশিষ গর্বের ছেলে। সে এডুকেশন বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ও বি.এড. ডিগ্রী ধারী। একটা চাকরি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্নেহাশিষই জানালো, ‘স্যার, ঐ ছেলে গুলো কেউ পড়াশোনা করে না। স্কুলে যায় না। নূন্যতম অক্ষর জ্ঞানটুকুও ওদের নেই’। সে আরও বলল, ‘আর কিছুদিন পর ওরা দিনমজুরির কাজে চলে যাবে, নেশাভান করবে’। ঘরের কাছে প্রাইমারি স্কুল থাকলেও এরকম বহু রূপকুমারই স্কুলের মুখ দেখেনি। আর ওদের এগিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। শিক্ষার আলোকিত জগৎ ওদের কাছে আজও অধরা।

     এই দুটি ঘটনাই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া ব্লকের হাউর অঞ্চলের আমদান গ্রামের। এই গ্রামে আদিবাসী হো, সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা, ভূমিজ সম্প্রদায়ের প্রায় ১৪০টি পরিবারের বাস। আদিবাসো জনসংখ্যা প্রায় ৭০০ জন। ওদের পাশে থাকার দুনির্বার আকর্ষণে ওদের মাঝে হাজির হই বারে বারে। আন্তরিক সম্পর্কের গভীরতা দিয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি সমস্যার শিকড়ে। অকপট স্বীকারে দ্বিধা নেই, স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছরের দোরগোড়ায় এসে শিক্ষা আজও ‘সকলের শিক্ষা’ নয় ওদের কাছে। ‘সবার শিক্ষা’ আজ বড্ড বেশি প্রয়োজন ওদের। পারিবারিক আর্থিক দুর্দশায় বাড়ির বড়রা সারাদিন দিনমজুরিতে ব্যস্ত। পড়্রাশোনা চুলোয় যাক! বাড়ির বড়রাও চায় শিশুহাত গুলোও তাদের আর্থিক উপার্জনের সহযোগী হোক। আজও হো সমাজে অন্তঃসলিলা প্রবাহিত হয় কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস। অশিক্ষা থেকে জন্ম নিচ্ছে বিশৃঙ্খল জীবন। অবহেলা স্বাস্থ্যে, অবহেলা সংস্কৃতিতে। পানীয় জল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল সবই রয়েছে সরকারি আয়োজনে। শুধু যোগসূত্র স্থাপনের অভাব। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?

    অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কংসাবতী-সুবর্ণরেখা অববাহিকাতে প্রাগৈতিহাসিক মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিবর্তণ ঘটেছিল। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেই অস্ট্রো-এশিয়টিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা এতদাঞ্চলে নদী মাতৃক ও কৃষি-শিকার ভিত্তিক সভ্যতার সূচনা করেছিল। তাদের উত্তসূরীরা আজ ভালো নেই। ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েই ওদের সামনে হাজির হয়েছিলাম অন্য দিনের মতোই। তবে একটু আলাদা স্বাদ নিয়ে। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের একদিনের ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। ওদের একটু আলাদা জীবন উপহার দেওয়ার তাগিদ থেকেই। শিশুরা দুপুরের আহারে ভাত, ডাল, সবজি, মুরগী মাংস, চাটনি, দই ও পাপড় পেয়ে উপহার দিয়ে গেল শত গোলাপের হাসি। নতুন জামা প্যান্ট পাওয়া সবচেয়ে ছোট্ট শিশুটির হাসিমুখ দেখে মনে পড়ে গেল Oscar Wilde এর লেখা গল্প ‘The Selfish Giant’-র ছোট্ট শিশুটির কথা। গল্পের শেষে শিশুটি বলছে, “You let me play once in your garden; today you shall come with me to my garden, which is paradise.” অনেক ‘ভালো নেই’ এর মাঝে অনুভূতিটা সত্যিই স্বর্গীয়! হলোই বা ক্ষণিকের!

© রূপেশ সামন্ত

 

সংবাদ প্রতিবেদন-১

https://www.facebook.com/101248021405457/posts/336257194571204/

সংবাদ প্রতিবেদন-২

https://fb.watch/660O9qMfhI/

No comments:

Post a Comment