Popular Posts

Monday, 25 November 2024

মেদিনীপুর ক্যানেল জলপথের অতীত কথা

 

মেদিনীপুর ক্যানেল জলপথের অতীত কথা

রূপেশ কুমার সামন্ত

তীতে পাঁশকুড়ায় জলপথের গূরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল কাঁসাই, ক্ষীরাই, বাকসী প্রভৃতি নদী ও খাল। এইসব জলপথে নৌকা, যন্ত্রচালিত নৌকা ইত্যাদি চলাচল করত। মূলত বর্ষাকালে বা জোয়ারের সময় মানুষ পরিবহনের কাজ বেশি করে করত। তখন স্থলপথে পরিবহন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল ছিল। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে পর্যন্তও নৌকা বা যন্ত্রচালিত নৌকায় মাল পরিবহন করতে দেখা গেছেশুধু নৌকা নয়, নদীপথে শ’য়ে শ’য়ে বাঁশ বা কাঠ ভাসিয়ে দিয়ে স্রোতের টানেও পরিবহন হত। এমনকি বিয়ে বাড়ির বরযাত্রী বা কন্যাযাত্রী পরিবহনেও বন্যার সময় জলভরা মাঠের মধ্য দিয়ে, নদী-খাল দিয়ে নৌকা বা যন্ত্রচালিত নৌকা ব্যবহৃত হত। কলাগাছে ভেলা তৈরি করে মানুষ নদী-খাল পারাপার বা মৎস শিকার করত। পরবর্তীতে বন্যা প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে উঠলে, নদী-খালের নাব্যতা কমে গেলে, স্থলপথ যোগাযোগ উন্নত হলে, নদী-খালে ব্রীজ তৈরি হয়ে গেলে জলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমশ গূরুত্ব হারায়।

     হাওড়া বা কলকাতা যাতায়াতের জন্য স্থলপথে যানবাহন পাওয়া দূরুহ ছিল। এছাড়াও কাঁসাইয়ের জলপথে যাতায়াতের জন্য দূরত্ব অনেক বেশি ছিল। ফলে মেদিনীপুর থেকে হাওড়ার সাঁকরাইল পর্যন্ত নৌ চলাচলের জন্য ব্রিটিশরা একটি খাল খননের পরিকল্পনা করে। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া ইরিগেশন এণ্ড ক্যানেল কোম্পানি’কেএই ক্যানেলের নামকরন হয় মেদিনীপুর ক্যানেল। এই ক্যানেলের খনন কার্য শুরু হয়েছিল ১৮৬৬ সালে এবং শেষ হয় ১৮৬৮ সালে। এছাড়াও ক্যানেল থেকে সেচ কার্য শুরু হয় ১৮৭১ সালে। L.S.S. O’Malley তাঁর ‘Bengal District Gazetteers- Midnapore’ এ লিখেছেন, ‘The construction of the Midnapore canal was begun by the East India Irrigation and Canal Company in 1866; the works were taken over by the Government two years later, and irrigation commenced in 1871.’ ক্যানেলের জল সরবরাহের উৎস মোহনপুরের কাছে কংসাবতী নদী। ক্যানেলটি মোহনপুর থেকে উলুবেড়িয়ার কাছে হুগলী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছেপ্রবাহপথের মাঝে পাঁশকুড়ার কাছে কংসাবতী নদী, কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণ নদী ও হাওড়া জেলার দামোদর নদী অতিক্রম করে হুগলী নদীতে পড়েছে। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পটি প্রকৃতপক্ষে ওড়িশা ক্যানেল প্রকল্পেরঅধীন ছিল। কলকাতা ও কটকের মধ্যে একটি নতুন জলপথ তৈরির জন্য প্রকল্পটি তৈরি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে এটি পূর্বতন মেদিনীপুর জেলার আলাদা একটি প্রকল্প হিসাবেই রূপায়িত হয়।

     যাইহীক, ১৮৭৩ সালে কোম্পানি জলপথে ব্যবসা শুরু করে। লঞ্চ পরিষেবা শুরু হয়। মাল ও যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। পুরানো পাঁশকুড়ায় থানার কাছে একটি লকগেট তৈরি হয়। ঐ লকগেট জলপথ-ষ্টেশন রূপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। পাঁশকুড়ার যাত্রী ও পন্য ওখানেই ওঠানামা করত। পাঁশকুড়া থানার কাছে কাঁসাই পাড়ে স্থিত নোঙরের শিকল বাঁধার একটি স্থম্ভ তারই সাক্ষ্য বহন করে। ইন্দুমতী দেবী (জন্ম-১৮৮৮) তাঁর ‘স্মৃতিকনা’ গ্রন্থে লিখেছেন,-‘রেল চালু হবার আগে, মেদিনীপুর ক্যানেল দিয়ে ছোট স্টীমার চড়ে কলকাতা যেতে হত। পাঁশকুড়া বাজারে ষ্টীমারে উঠতে হত। সকালে রওয়ানা হয়ে কলকাতা পৌঁছতে বিকাল গড়িয়ে যেত’ কাঁটাপুকুরের কাছে রূপনারায়ন নদী চওড়া হয়ে যাওয়ার ফলে নৌযান চলাচলে সমস্যা তৈরি হতে থাকে। এরপর রেল পরিষেবা শুরু হওয়ার পর জলপথের গূরুত্ব কমতে থাকে। তখন ১৯০৬ সালে ক্যানেল কোম্পানি জলযানের মাশুল অর্ধেক করে দেয়। এরপর যাতায়াত কিছুটা বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, কংসাবতী ও মেদিনীপুর ক্যানেলে তৎকালীন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও ঘাটাল-কোলাঘাট-তমলুক স্টীমার সার্ভিস চালু ছিল। ক্যালকাটা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির এজেন্ট হোরমিলার কোম্পানি এই সার্ভিস চালু করেছিল। স্টীমারগুলি ছিল দোতলা এবং এগুলিতে দুটি করে চোঙ থাকত। স্টীমার গুলি চলতো রূপনারায়ণ নদীতে। স্টীমার থামত দেনান ষ্টেশনে। স্টীমার গুলির নাম ছিল ‘ষোড়শী’, ‘শীতলা’, ‘কিন্নরী’, ‘উর্বশী’, ‘সুকেশী’ ইত্যাদি।

No comments:

Post a Comment