Monday, 26 May 2025

প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন বেগুনবাড়ির কালিপূজা

 প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন বেগুনবাড়ির কালিপূজা











তথ্যসূত্র:
পাঁশকুড়ার পুরাকীর্তি ও উপাসনা স্থল

© Rupesh Kumar Samanta 

Friday, 16 May 2025

নাড়াজোল রাজবাড়ি- ছবির মতো...

রাজবাড়ির সম্মুখভাগ


ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দির।


নাটমন্দিরে পালকি


নাটমন্দিরে বেলজিয়াম গ্লাসের শিল্পকর্ম 


নাটমন্দির ও পেছনে 


গোবিন্দজিউর মন্দির


মন্দিরের সামনের দেওয়ালে টেরাকোটা ফলকের কাজ


নবরত্ন মন্দির


রাজবাড়ির প্রশাসনিক ভবন সমূহ


অন্তর্গড়ের রাজবাড়ি


ভগ্নপ্রায় দুর্গামন্দির চত্ত্বর


প্রাচীন জীর্ণশীর্ণ জয়দুর্গা মন্দির


রাজবাড়ি 


রাজবাড়ির প্রশাসনিক ভবনের দেওয়ালে টেরাকোটার কাজ


রাজবাড়ির বিভিন্ন প্রশাসনিক বাড়ি


দুর্গামন্দিরের নাটমন্দির 


রাজা নরেন্দ্রলাল খানের মা নিস্তারিণী দেবী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মৃত্যুঞ্জয় শিব মন্দির


অন্তর্গড়ের কাছারিবাড়ি


নহবত খানা

নহবতখানা


কিংবদন্তীর নিমগাছ যার পাতা স্বাদে তিক্ত নয়


কাছারি ময়দান


বহির্গড়ে রাজবাড়ির ফটক


বহির্গড়ের কাছারি বাড়ি


ষষ্ঠ শিবালয় মন্দির


১৭৬৫ শকাব্দে রাজা মোহনলালের পঞ্চম পুত্র ব্রজকিশোর খান প্রতিষ্ঠা করেন


২৫ চূড়া রাসমঞ্চ


রথ


রাজবাড়ি



 সঙ্গী ছিল বাপি সাউ

Sunday, 11 May 2025

প্রসঙ্গ বাংলাদেশ: আওয়ামিলীগকে নিষিদ্ধকরণ এক রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার নিদর্শন

 প্রসঙ্গ বাংলাদেশ:

আওয়ামিলীগকে নিষিদ্ধকরণ এক রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার নিদর্শন 



✍️নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শকে মুছে ফেলা যায় না। বরং তা গুমরে গুমরে আরও তীব্র রূপে একদিন বিস্ফোরিত হয় অথবা অন্য কোন নামে আরও সংগঠিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অন্যদিকে যারা রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে নিষিদ্ধকরণের মতো জঘন্য কাজটি করেন, তাঁরা তাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ তাঁদের অজ্ঞাতেই জনসাধারণের কাছে ঘটিয়ে ফেলেন। তাই বিরোধী দলের রাজনৈতিক মোকাবিলা করাটাই অনেক বেশি রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয়, যা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।


বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত নাম। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এমন একটি দলকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব বা উদ্যোগ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবজ্ঞার পরিচয় বহন করে।


রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড:

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভিন্নমত ও বহু দলীয় রাজনীতি স্বাভাবিক ও জরুরি। একটি জনপ্রিয়, বহুসমর্থিত রাজনৈতিক দলকে কেবলমাত্র মতবিরোধ বা ক্ষমতা পালাবদলের লড়াইয়ের কারণে নিষিদ্ধ করার চিন্তা গণতন্ত্রের আত্মাহুতি দেওয়ার নামান্তর। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার অর্থ শুধু একটি দল নয়, বরং ইতিহাস, একটি আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করা।


একটি দলকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া সাধারণত আসে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রদ্রোহ কিংবা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তা দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্ম দেয়, যেখানে আইন নয়, রাজনৈতিক স্বার্থই মূল চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। এটি শুধু যে এক ধরনের দেউলিয়াপনা তা নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

 রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু এসব মোকাবেলার জায়গা জনগনের দরবার,  সংসদ ও ব্যালট বাক্স। সেন্সর বা নিষেধাজ্ঞা নয়। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকাই সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখে। আর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার মানে পুরো রাজনীতিকে একমুখী ও একনায়কতান্ত্রিক পথে ঠেলে দেওয়া।


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া;

 একটি ঐতিহাসিক ও অতীত-ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একটি দলের কিছু নেতা বা নীতি খারাপ হলেও তার জন্য আইন আদালত রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে আওয়ামিলীগের বিরুদ্ধে এখনও সেরকম কিছু আইনী প্রক্রিয়া চোখে পড়েনি। এই দলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়াও চোখে পড়েনি। 


সর্বপোরি বিষয়টিকে বাংলাদেশের জনগন কি চোখে দেখছে সেটাই বড় বিষয়। যাই ঘটুক এই রকম একটি অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধু সিদ্ধান্তকারীদেরই শুধু দেউলিয়াপনা প্রকাশ করে না, একটি রাস্ট্রও রাজনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার দিকে এগিয়ে যায়।


 ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেকোনো মত বা দলকে দমন করে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যায় না — বরং তা নতুন রূপে, আরও তীব্রভাবে ফিরে আসে। তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা হোক রাজনৈতিক ময়দানে, নিষেধাজ্ঞা বা দমন নীতিতে নয়।


©  রূপেশ সামন্ত

লবন থেকে লক্ষ্মী- পলাশীর নন্দীদের জমিদারী উত্থানের গল্প

 লবন থেকে লক্ষ্মী- পলাশীর নন্দীদের জমিদারী উত্থানের গল্প

রূপেশ কুমার সামন্ত






















ভূমিকা

কাশিজোড়ার ধান, ময়না রাজার মান।

কুচোল ঘোড়ইয়ের পাকা, দে-নন্দীর টাকা।

পলাশীর নন্দী বাড়ির অঢেল ঐশ্বর্যকে ইঙ্গিত করেই প্রবচনের আপ্তবাক্যের ‘নন্দীর টাকা’ অংশটি প্রতিষ্ঠিত। উনবিংশ শতকের গোড়ায় উদীয়মান ব্যবসায়িক পরিবার নন্দীরা লবন ব্যবসার উপর ভিত্তিক করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিল। তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন। শাসকের কৃপা ও অর্থ-বলের মেলবন্ধনে কিভাবে অর্থ নামক ‘চঞ্চলা লক্ষ্মী’কে বশিভূত করে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’কে উপচে ফেলতে হয়, তা নন্দীরা ভাল জানত। তাঁরা লবন ব্যবসার অর্থকে বিনিয়োগ করে জমিদারী ক্রয় করলেন। নন্দী পরিবারের সুযোগ্য সন্তান শ্রীনাথ নন্দী ও দীনবন্ধু নন্দী ডেবরার পলাশীতে গড়ে তুললেন জমিদারী সাম্রাজ্য। ফুলেফেঁপে উঠল জমিদারী ‘রাজকোষ’। তাঁরা গড়ে তুললেন বিরাট জমিদারী সাম্রাজ্য, বিলাসবহুল বাড়ি, রাজকীয় মন্দির, অনিন্দ্যসুন্দর রাসমঞ্চ। তৎকালীন দারিদ্র-পীড়িত সমাজের মাঝে নন্দী বাড়ির রাজকীয় বৈভব মানুষের মননে রূপকথার গল্প হিসাবে স্থান করে নেয়। আর প্রবচন হয়ে ঘুরে বেড়ায় মানুষের মুখে মুখে।


নন্দীদের জমিদারী প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৭৯৩ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন করেন। এর ফলে বাংলার রাজস্ব বিভাগ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। নতুন এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী, জমিদারদের সঙ্গে বার্ষিক রাজস্ব নির্ধারিত হারে স্থায়ীভাবে চুক্তি সম্পাদিত হয়। সেই রাজস্বের পরিমান পূর্ববর্তী দশসালা বন্দোবস্তের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ফলে জমিদারদের একটি অংশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট করের বোঝা বহন করে জমিদারী ধরে রাখার কাজটি কঠিন ছিল। উপরন্তু, খরা, বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য কর পরিশোধে কোন ছাড় ছিল না। ফলস্বরূপ, তাৎক্ষণিকভাবে অনেক জমিদারের কর বকেয়া পড়ে যায়। বকেয়া জমিদারির জমি নিলামে তোলার কোম্পানির নীতির ফলে জমির বাজার তৈরি হয়। বর্ধিত করের বোঝা মেনে নিয়ে কিছু প্রাচীন জমিদার তাঁদের জমিদারি রক্ষা করতে সক্ষম হন। কিন্তু অনেকে কর দিতে অসম্মত হওয়ায় বা অপারগ থাকায় তাঁদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হয়। ঠিক এই সময়েই গড়ে ওঠে এক নতুন শ্রেণির জমিদার—যাঁরা বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে বিপুল অর্থ সঞ্চয় করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে জমিদারি বন্দোবস্ত গ্রহণ করেন। কেউ কেউ আবার জমিদার বা তালুকদারদের কাছ থেকে জমিদারী বন্দোবস্ত নিয়ে অথবা সরাসরি জমিদারি কিনে জমিদার হয়ে ওঠেন। এই নতুন জমিদার শ্রেণির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মেদিনীপুর শহরের জন্মেজয় মল্লিক, মালিঘাটির ছকুরাম চৌধুরী এবং পলাশীর শ্রীনাথ নন্দী ও দিনবন্ধু নন্দী। এই নতুন জমিদার শ্রেণি বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছিলেন।


জমিদারী প্রতিষ্ঠা

নন্দী পরিবারের আদি নিবাস ছিল বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুর গ্রামে। সেই সময় রেশম শিল্পে উন্নতির কারণে আনন্দপুর মেদিনীপুর জেলার মধ্যে অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রেশম শিল্পের সেই রমরমা বাজারেও দূররদর্শী নন্দী পরিবার রেশম ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়নি। তাঁরা করতেন মানুষের অতি প্রয়োজনীয় ও নিত্য-ব্যবহার্য লবনের ব্যবসা। ১৮শ শতকের মাঝামাঝি থেকে ইংল্যান্ডে শুরু হয় শিল্প বিপ্লব, যা পরে পুরো ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপ্লবের ফলে ইউরোপীয়দের প্রচুর কাঁচামাল ও নতুন বাজারের প্রয়োজন দেখা দেয়। তারা উপনিবেশ থেকে সেই কাঁচামাল সংগ্রহ করা এবং সেখানে নিজেদের তৈরি পণ্য রপ্তানি করার নীতি গ্রহন করে। সেই সময় কোম্পানি ভারতীয় লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ করে বিদেশ থেকে কল-কারখানায় প্রস্তুত লবণ আমদানি করার নীতি নেয়। লবণ বোঝাই জাহাজ এসে ভিড়ত কলকাতার বন্দরে। নীলামে ডাকা সেই লবণ সংগ্রহ করে, বস্তাবন্দী করে বাজারজাত করাই ছিল নন্দী পরিবারের দায়িত্ব। তাঁদের কলকাতার ব্যবসা কেন্দ্র ছিল ২ নং অহিরীটোলা স্ট্রিট। লবণ পরিবহনে সুবিধা পাওয়ার জন্য তাঁরা আনন্দপুর ছেড়ে প্রথমে চলে আসেন ডেবরার ডাররা গ্রামে। তারপর সেখান থেকে চলে আসেন কাঁটাপুকুরে। এই স্থানান্তরের মূল কারণ ছিল কলকাতা থেকে মেদিনীপুর অঞ্চলে লবণ পরিবহনের সুবিধা, যা তখন জলপথেই সবচেয়ে সহজ ছিল। পলাশী গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে মেদিনীপুর খাল। সেই সময়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের অন্যতম প্রধান পথ ছিল এই খাল। লবণ ব্যবসা থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছিলেন নন্দীরা। লবন ব্যবসার সূত্রে ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগের সুবাদে শ্রীনাথ নন্দী ও দীনবন্ধু নন্দী অর্থ বিনিয়োগ করে তাঁদের জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পলাশী গ্রামে গড়ে তুললেন স্থায়ী জমিদারী বসতি। পলাশী গ্রামটি পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা থানার অন্তর্গত। এই পলাশী গ্রামে আজও রয়েছে সেই জমিদারী বাড়ি, রাজকীয় লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির, রাসমঞ্চ ও ধ্বংসপ্রায় বিশাল নাটমন্দির। 

জমিদার পরিবার

পলাশীতে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীনাথ নন্দী ও দিনবন্ধু নন্দী। জমিদার পরিবারের বংশলতিকা বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দুই পুরুষ আগে জমিদার পরিবারের সর্বোচ্চ পুরুষ ছিলেন গোবিন্দ চরণ নন্দী। তাঁর পুত্র ছিলেন যুগল বিহারী নন্দী। যুগল বিহারীর দুই পুত্র ছিলেন- পুরুষোত্তম ও গোলক মোহন নন্দী। পুরুষোত্তমের একমাত্র পুত্র ছিলেন শ্রীনাথ। অন্যদিকে গোলক মোহনের একমাত্র পুত্র ছিলেন দীনবন্ধু। এই শ্রীনাথ নন্দী ও দীনবন্ধু নন্দীর হাত ধরেই জমিদারী প্রতিষ্ঠা। শ্রীনাথ নন্দীর পুত্র ছিলেন নবদ্বীপ নন্দী। নবদ্বীপের দুই পুত্র ছিলেন- কিশোরী রঞ্জন ও শান্তভূষণ। কিশোরী রঞ্জন ছিলেন নিঃসন্তান। শান্তভূষণের ছিল পাঁচ পুত্র- ব্রজদুলাল, রামদুলাল, সুহৃদ কুমার, প্রণব কুমার ও প্রাণ কুমার। ব্রজদুলালের পুত্র ছিলেন দেবাশীষ নন্দী। অপর দিকে দীনবন্ধু নন্দীর দুই পুত্র ছিলেন অধরচাঁদ এবং রাইচরণ। এদের মধ্যে রাইচরণ ছিলেন নিঃসন্তান। অধরচাঁদের চার পত্নীর মধ্যে প্রথমা পত্নীর সন্তান ছিলেন নীরদ বরণ এবং চতুর্থ পত্নীর সন্তান ছিলেন ননীগোপাল। বাকি দুই পত্নীর কোন সন্তান ছিল না। নীরদ বরণের দুই পুত্র ছিলেন অমলেন্দু ও বিমলেন্দু। অমলেন্দুর তিন পুত্র ছিলেন প্রদীপ, সপ্তদীপ ও সন্দীপ। বিমলেন্দুর পুত্র ছিলেন কৃষ্ণেন্দু। অপরদিকে, ননীগোপালের পুত্র ছিলেন শুভেন্দু এবং তাঁর পুত্র ছিলেন সংলাপ।

মন্দির স্থাপন

জমিদারী বসত বাড়ির পূর্বদিকে নির্মিত হয়েছে লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দির। রাজকীয় মন্দিরটি জমিদারী বৈভবের বহিঃপ্রকাশ। পূর্বমূখী মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে দালান রীতিতে। উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত আয়তকার মন্দিরটি খিলান রীতিতে নির্মিত তিনটি প্রবেশ দ্বার যুক্ত। প্রবেশ দ্বারের পরেই রয়েছে প্রসারিত অলিন্দ। অলিন্দের পেছনে রয়েছে তিনটি কক্ষ। মাঝের গর্ভগৃহে রয়েছে দেবতার অধিষ্ঠান। মন্দিরের সামনের দেওয়ালে অনিন্দ্যসুন্দর নানান টেরাকোটা ফলক এখনও বিদ্যমান। টেরাকোটা ফলকে দৃশ্যমান দেবী দশভূজা, বংশীবাদন রত শ্রীকৃষ্ণ, দশাবতার, বাজনা বাদক ও নানান সামাজিক দৃশ্য। মন্দিরের শীর্ষে রয়েছে গরুড় মূর্তি।  


নাটমন্দির

মন্দিরের সামনে পূর্বদিকে ছিল দোতলা-সম বিরাট নাটমন্দির। বিশাল বিশাল গোলাকৃতির থামের মাথায় সমতল ছাদ দিয়ে নাটমন্দিরটি তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। সেই নাটমন্দিরটি বর্তমানে ধ্বংসপ্রায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত গোলাকার থামের শেষ চিহ্ন গুলি এখনো দেখা যায়। চারিদিকে বিশাল উঁচু প্রাচীর এখনও বিদ্যমান। নাটমন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে একটি অব্যবহৃত প্রসস্থ সুড়ঙ্গ রয়েছে। বাহ্যিক ভাবে এখনও দৃশ্যমান সেই সুড়ঙ্গটি দোতলা থেকে মাটির নিচে নেমে এসেছে। সুড়ঙ্গটি নিয়ে নানান রহস্য-গল্প লোকমুখে আজও প্রচারিত।  


বিগ্রহ ও পুজার্চনা

জমিদার বাড়ির লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরে লক্ষ্মী-নারায়ণের কোন বিগ্রহ নাই। শালগ্রাম শিলাই তাঁর বিগ্রহ হিসাবে পুজিত হন। পুজার্চনার জন্য প্রায় সমূহ জমিদারী সম্পত্তি দেবতার নামে উৎসর্গ করে দিয়েছিল জমিদার পরিবার। জমিদারীর বিপুল অর্থে একটি রাজকীয় মন্দির নির্মান করে ছিলেন তাঁরা। বিভিন্ন পার্বন ও নিত্যপুজায় বিপুল অর্থ ব্যয় করত জমিদার পরিবার। ফলে প্রতিটি পার্বন হত অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে দেবত্ত্বর সম্পত্তি খাস হয়ে যাওয়ায় ভাঁড়ারে টান পড়ে। বর্তমানে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে না হলেও দিনে তিনবার নিত্যপুজা হয় এখানে। সকালে ফলমুলের সাথে মিষ্টান্নের বাল্যভোগ দেওয়া হয়। দুপুরে লুচি ও তিনটি ভাজা সহ ভোগ দেওয়া হয়। রাতে লুচি ও ক্ষীর ভোগ নিবেদন করা হয়। বিভিন্ন বার্ষিক পার্বনে যথা সম্ভব জাঁকজমক বজায় রাখা হয়। এখানে শ্রাবন মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী থেকে তিন দিনের ঝুলনযাত্রা হয়। ভাদ্রমাসে পালিত হয় জন্মাষ্টমী ও রাধাষ্টমী। কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় এখানে রাস উৎসব হয়। এজন্য সুদৃশ্য ও রাজকীয় এক রাসমঞ্চও রয়েছে। এই উৎসব বিশ দিন যাবৎ চলে। রাস উৎসবের পূর্বে পালিত হয় গোবর্ধন যাত্রা। পৌষ সংক্রান্তিতে পালিত হয় মকর। এছাড়াও ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় পালিত হয় দোল উৎসব।


জমিদারী উচ্ছেদ

জমিদারী উচ্ছেদ ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে কৃষকদের জমির মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং জমিদারদের শোষণমূলক প্রথার অবসান ঘটে। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার মাধ্যমে যে জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে, তা ভারতে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে চিরস্থায়ী বিলুপ্তির পথে যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫৩ সালের 'Estates Acquisition Act'-এর মাধ্যমে জমিদারদের অতিরিক্ত জমি সরকার অধিগ্রহণ করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে এবং ভূমির মালিকানা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এইভাবে উনবিংশ শতকের গোড়ায় পলাশীর শ্রীনাথ ও দীনবন্ধু নন্দীর হাত ধরে গড়ে ওঠা পুরুষানুক্রমের জমিদারী স্বাধীন ভারতে উচ্ছেদ হয়ে যায়। জানা যায়, জমিদারী উচ্ছেদের ফলে বিপুল পরিমান দেবোত্তর সম্পত্তি খাস হয়ে যাওয়ায় সরকার থেকে মাত্র ১১,১৪৪ টাকা বার্ষিক ভাতা ধার্য্য করা হয়। এই অর্থে আর জমিদারী বৈভব বজায় রাখা সম্ভবপর ছিল না। ধীরে ধীরে রাজকীয়তার পলেস্তারা খসতে থাকে। ভেঙে পড়ে বিশাল নাটমন্দির। একসময় সেখানে বসত জমিদারী বিচার সভা। নাট্যমঞ্চে পরিবেশিত হত নাটক, নৃত্য, যাত্রা। তবে আজও প্রবচনের ‘নন্দীর টাকা’র জোরকে সত্য প্রমান করে দাঁড়িয়ে আছে জমিদারী বাড়ি, রাজকীয় মন্দির ও রাসমঞ্চ।

তথ্যসূত্রঃ

১। লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, পলাশী (ডেবরা), চিন্ময় দাশ, সব্যসাচী পত্রিকা, ২১.০৩.১৬

২। নুনের ব্যবসায়ী থেকে জনিদারীঃ পলাশী, নারায়ণ রুদাস

৩। পাঁশকুড়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, রূপেশ কুমার সামন্ত

৪। ক্ষেত্রসমীক্ষা- ১৪.০৪.২৫

জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

  জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল? জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠি...