-------- ----- --- --আদর্শ
ছাত্র-- --- ----- --------
‘ধনঞ্জয় স্যার ক্লাসে আসছেন? কি আর
করবে! আমি অতো ভয় পাই না।’ বুম্বা বলল। বুম্বা তখনও হাইবেঞ্চে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে
বসে সমানে দাদাগিরি করছে। হাতের আঙ্গুলে ‘সুদর্শণ চক্রে’র মতো গলার চেনটাকে নিয়ে
বনবন ঘুরিয়ে চলেছে। পাশে সাঙ্গোপাঙ্গরা যোগ্য সঙ্গত করছে। দশম শ্রেণির ইংরাজীর
ক্লাস। ধনঞ্জয়বাবু ক্লাসে প্রবেশ করলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের ফার্স্টবয় তথা
মনিটার নান্টু উঠে দাঁড়াল এবং বুম্বার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ জানালো। বুম্বা সব
দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় শাস্তিটা একটু কমই হল। মাত্র পঞ্চাশ বার কান ধরে ওঠ-বোস।
কিন্তু নান্টু ছাড়ার পাত্র নয়। সে আবার অভিযোগ আনল, ‘স্যার, ওর পকেটে ছুরি আছে।’
বুম্বা হাতে নাতে ধরা পড়ল। বুম্বার আত্মপক্ষ সমর্থনের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল।
স্বভাবতই বিচার পাঠিয়ে দেওয়া হল হেডস্যারের কোর্টে।
হেডস্যার গার্ডিয়ান-কল-লেটার বুম্বার
হাতে ধরিয়ে পরের দিন বাবা সহ দেখা করতে বললেন। এদিকে আগামীকাল স্টাফ কাউন্সিল
মিটিং ডাকা হয়েছে বুম্বার শাস্তির বিষয়টি আলোচনার জন্য।
স্টাফ কাউন্সিল মিটিংয়ে বুম্বাকে
টি.সি. দেওয়ার জন্য ধনঞ্জয়বাবু জোরদার সওয়াল করলেন। আরও কিছু শিক্ষক ধনঞ্জয়বাবুর
পক্ষ নিলেন। কেউ বলল, ‘ও একটা ক্রিমিন্যাল।’ কেউ বলল, ‘ওর জন্যই ক্লাসের ডিসিপ্লিন
নষ্ট হচ্ছে।’ বুম্বার শাস্তির পক্ষে সবাই প্রায় এককাট্টা। ঠিক এমন সময় স্টাফ
কাউন্সিল সেক্রেটারী তথা ইংরাজীর আরেক জন শিক্ষক সমরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘ক্রিমিন্যালই হোক, বা ইনডিসিপ্লিন্ড। দায়ী কিন্তু আমরাই। ও তো ছোট ছেলে! ওর
কাউন্সেলিং প্রয়োজন। ওকে আরো সুযোগ দেওয়া উচিৎ।’ সমরেশবাবু অত্যন্ত দায়িত্ববান
শিক্ষক এবং প্রভাবশালীও। হেডস্যার সমরেশবাবুর কথা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তাই কঠোর
শাস্তির পরিবর্তে বুম্বাকে সতর্ক করার পক্ষেই মত দিলেন। বুম্বার বাবাকে সবটা
জাাানিয়ে এবারের মতো বুম্বাকে ছেড়ে দেওয়া হল।
সমরেশবাবু বুম্বাকে একান্তে ডেকে
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি ছুরি নিয়ে ক্লাসে এসেছো?’ বুম্বা বলল, ‘না স্যার। আমি কাঁচা
আম কাটার জন্য ছোট একটা ছুরি এনেছিলাম। নান্টু আমাকে সবসময় ধনঞ্জয় স্যারের ভয়
দেখায়। তাই ওকে আমি ছুরি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ছিলাম।’ তখন সমরেশবাবু বললেন, ‘কিন্তু
তুমি ক্লাসে খুব ডিস্টার্ব করো। তোমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না?’ বুম্বা বলল,
‘না স্যার। আমার শুধু খেলতে ভালো লাগে।’ সমরেশবাবু বললেন, ‘ক্লাসে আর গন্ডগোল করবে
না। কাল থেকে অ্যানুয়াল স্পোর্স্টস শুরু হচ্ছে। অনেক কাজ আছে। আগামীকাল সকাল
সাতটায় চলে আসবে।’ ‘ঠিক আছে স্যার’, বলে বুম্বা চলে গেল।
পরদিন বুম্বা সকাল ছ’টা থেকে
সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হাজির। গোটা মাঠ দাপিয়ে খেলার প্রস্তুতির কাজ করে যাচ্ছে। শুধু
কোন কিছুর নির্দেশ দিলেই হল! সঙ্গে সঙ্গে কাজ হাসিল। এরপর খেলা শুরু হল। বুম্বা
দু’শো মিটার দৌড়ে প্রথম। ছুটে এসে সমরেশবাবুকে ট্রফিটা দেখালেন। সমরেশবাবু বুম্বার
পিঠটা চাপড়ে দিলেন।
কয়েক দিন পর বুম্বা আরেক কাণ্ড ঘটিয়ে
বসল। টিফিনে মেয়েরা যখন দো’তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, তখন বুম্বা পা বাড়িয়ে
দেওয়ায় শিউলি সিঁড়ির মধ্যে পড়ে যায়। হাত কেটে গিয়ে গলগল রক্ত বেরোচ্ছে। এরপর
নান্টু দ্রুততার সঙ্গে খবরটা ধনঞ্জয়বাবুর কানে তুলে দেয়। তখন ধনঞ্জয়বাবু প্রবল
উৎসাহে ঘটনাটি হেডস্যারের কানে তুলে এবং টি.সি. দেওয়ার জন্য দাবী করে। স্বভাবতই
গার্ডিয়ান-কল-লেটার বুম্বার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। স্টাফ কাউন্সিল মিটিংও ডাকা হল।
স্টাফ কাউন্সিল মিটিংয়ে আক্রমনের ঝড়
দেখে সমরেশবাবু নিজেকে মৌন রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। টি.সি. দেওয়ার সুপারিশ পরিচালন
কমিটির সভায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সমরেশবাবু বুম্বাকে ডেকে এইরূপ আচরনের
কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। বুম্বা বলল, ‘আমি পড়া পারিনা বলে শিউলি ক্লাসে সবসময় আমাকে
ইনসাল্ট করে। তাই আমি ওকে ফেলে দিয়েছি।’ সমরেশবাবু ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি অন্যায়
করেছ।’
সমরেশবাবু পরিচালন কমিটির সদস্য।
পরিচালন কমিটির সভায় অনেক লড়াই করে বুম্বার শাস্তি রদ করতে সমর্থ হল। তবে শেষবারের
মতো। পরবর্তী কালে বুম্বার কোন অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা
হেডস্যারকে দেওয়া হল।
নান্টু ধনঞ্জয়বাবুর খুবই প্রিয় ছাত্র।
ক্লাসে ফার্স্ট হয় এবং শৃঙ্খলাপরায়নও। বুম্বার শাস্তি মুকুবের কথা শুনে ধনঞ্জয়বাবু
রাগে ঘোষনা করলেন, ‘নান্টুর রেজাল্ট খারাপ হলে বুম্বাই দায়ী থাকবে। ওই ক্লাসটাকে
নষ্ট করছে।’
এরপর ক্লাসে প্রতিনিয়ত নান্টু সহ অন্যান্যরা বুম্বাকে ইনসাল্ট করতে থাকে। ধনঞ্জয়বাবুও কম যান না! তিনিও ক্রমাগত বুম্বাকে অপদস্ত করতে থাকেন।
এরপর ক্লাসে প্রতিনিয়ত নান্টু সহ অন্যান্যরা বুম্বাকে ইনসাল্ট করতে থাকে। ধনঞ্জয়বাবুও কম যান না! তিনিও ক্রমাগত বুম্বাকে অপদস্ত করতে থাকেন।
বুম্বার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে
থাকল। একদিন গোটা রাজ্যে একটি খবরে চাঞ্চল্য ছড়াল। খবরের কাগজের হেডিং, ‘আজ
ধনঞ্জয়ের ফাঁসি।’ ব্যাস! আজ যেন বুম্বার সমস্ত ভিতরের রাগ উগরে দেওয়ার দিন।
‘ধনঞ্জয়’ নামের মিলটাই যেন যথেষ্ট। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে একটি খড়ের পুতুল
বানালো। একটি কাগজে ‘ধনঞ্জয়’ কথাটি লিখে পুতুলে আটকে দিল। এরপর টিফিনে স্কুলের তিন
তলায় গিয়ে একটি ফাঁকা রুমে পুতুলটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিল। সঙ্গে উল্লাস আর চিৎকার,
‘ধনঞ্জয় স্যারের ফাঁসি! ধনঞ্জয় স্যারের ফাঁসি!’ খবর দ্রুত চাউর হয়ে গেল গোটা
স্কুলে। নান্টু ছুটল ধনঞ্জয় স্যারকে খবর দিতে।
হেডস্যারকে ধনঞ্জয়বাবু সহ কয়েক জন
শিক্ষক ঘিরে ধরল। টি.সি. দেওয়ার জন্য প্রবল চাপ দিতে থাকল। হেডস্যার টি.সি. লিখতে
শুরু করলেন। সমরেশবাবু নির্বাক। নিরুপায়ও। সমরেশবাবুর অভিমান ভরা রাগও হচ্ছিল
বুম্বার উপর। চাইছিলেন বুম্বা শাস্তিই পাক!
টি.সি. হাতে ধীরে ধীরে স্কুল থেকে
বেরিয়ে যাচ্ছে বুম্বা। মাথাটা নিচু। সমরেশবাবু বারান্দায় দাঁডিয়ে ছিল মাথাটা নিচু
করে। বুম্বা গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো সমরেশবাবুর দিকে একবার
তাকালেন। নান্টুর উল্লাস সমরেশবাবুর চোখ এড়ালো না। স্টাফরুম থেকে ধনঞ্জয়বাবুদের
উচ্ছাস কানে ভেসে আসছিল।
কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন স্কুল যাওয়ার
পথে সমরেশবাবুর বুম্বার সঙ্গে দেখা হল। রাস্তার পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। সঙ্গে
আরও অনেকে। বুম্বা প্রনাম করল। ‘তুমি এখন কি কোরছ?’ সমরেশবাবু জিজ্ঞাসা করল।
বুম্বা বলল। ‘আমি এখন মাটি কাটার কাজ করি, স্যার।’ স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে
সমরেশবাবু চলে গেলেন।
এরপর একদিন স্কুলে একটি ঘটনা ঘটল।
ক্লাসে দুষ্টুমি করায় ক্লাস ফাইভের সেরাফৎ নামে একজন ছাত্রকে ধনঞ্জয়বাবু খুব মারধর
করল। সেরাফৎ বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হল। যেন আগুনে
ঘি পড়ল। পরদিন স্কুলে সেরাফৎ এর বাবা-মা সহ পুরো পাড়া স্কুলে হাজির হল। স্কুল
ঘেরাও করল। তাদের দাবী, এখনই ধনঞ্জয়বাবুকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে অথবা পুলিশি
পদক্ষেপ করতে হবে। সমস্ত শিক্ষক ভয়ে জড়সড়। কিছু উটকো লোক জুটে গেল। ক্রমশ ভিড়
বাড়তে থাকল। দু’চারটে দোকানও বসে গেল। ফুচকা, চানা, পান, সিগারেট কত কিছু! হই হই
চলছে। শিক্ষক বিরোধী আবেগটা যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু
হয়ে গেল। এতো মানুষের আবেগ! এতো মানুষকে একসঙ্গে পাওয়া! মুখের কথা! সামনে ভোট।
অতয়েব কাজে লাগাতে হবে। মাইক বাঁধা হল। মাইকে ঘোষনা হচ্ছে, ‘আর কিছু ক্ষনের মধ্যে
এখানে এসে পৌঁছাবেন আমাদের যুবনেতা নান্টুদা।’
নামটা শুনেই চমকে উঠলেন ধনঞ্জয়বাবু।
যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার আদর্শ ছাত্র নান্টু আসছে। নিমেষে
চনমনে হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে নান্টু পৌঁছালো এবং জনতা পরিবৃত হয়ে জ্বালাময়ী
বক্তব্য শুরু করল। ধনঞ্জয়বাবু অফিস থেকে বেরিয়ে জনতার ব্যারিকেড ভেঙে নিশ্চিন্ত
আশ্রয় লাভের জন্য নান্টুর দিকে দৌড় লাগালো। জনতা রে রে করে উঠল। সবাই ধনঞ্জয়বাবুকে
ঘিরে ধারল। প্রবল উত্তেজনা আর ধাক্কা-ধাক্কির মধ্যে ছুটে এলো নান্টু। প্রবল উৎসাহে
ধনঞ্জয়বাবুর মুখে মারল একটা ঘুঁষি। ভোট যে বড় বালাই! জনতার সেন্টিমেন্ট বলে কথা!
এরপর আহত ও রক্তাক্ত ধনঞ্জয়বাবুকে ধরে
অফিসে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। অন্যান্য শিক্ষকদেরও অফিসে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে
দেওয়া হল। বাইরে নেতাদের ভাষন চলছে। সারা রাত্রি ব্যাপী আন্দোলনের তোড়জোড় শুরু হয়ে
গেছে। চলছে চাঁদা তোলাও।
এই অশান্তির খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
বুম্বার কানেও পৌঁছালো। বুম্বা কাছাকছিই একটি পুকুরে মাটি কাটার কাজ করছিল। খবরটা
শুনেই অন্যান্যদের নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটল। কারো হাতে কোদাল। কারো হাতে জঙ্গল সাফ
করার কাস্তে।
স্কুলের পেছন দিয়ে প্রাচীর টপকে
বুম্বা তার দলবল নিয়ে অফিসের সামনে পৌঁছে গেল। বুম্বাকে দেখে নান্টু যেন
তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। স্কুল জীবনের রাগটা আজই মিটিয়ে নেবে ঠিক করল নান্টু।
নান্টু দলবল নিয়ে বুম্বার দিকে তেড়ে গেল। বুম্বা সজোরে একটা ঘুঁষি চালালো নান্টুর
মুখে। নান্টু মাটিতে পড়ে গেল এবং গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল। নেতা পড়ে যেতেই জনতা
ছুট লাগালো এদিক ওদিক। সব ছত্রভঙ্গ। কোনরকমে দু’জন নান্টুকে ধরে তুলে নিয়ে চলে
গেল। চারিদিক শুনশান।
এরপর বুম্বার কোদালের এক ঘায়ে ভেঙে
গেল অফিসের দরজার তালা। বুম্বা অফিসে ঢুকে ঘোষনা করল, ‘আপনারা এখন নিরাপদ। এবার
নির্ভয়ে বাড়ি যান।’ হেডস্যারের চোখে জল। হেডস্যার বললেন, ‘এই চেয়ারে বসেই তোমার
টি.সি. লিখেছিলাম। তুমিই আজ এই চেয়ারের মর্যাদা রক্ষা করলে!’ বুম্বা বলল, ‘স্যার,
ছাড়ুন ওসব কথা।’ সমরেশবাবুর দিকে বুম্বা তাকালো। গর্বে রুদ্ধ হয়ে আসা কন্ঠে
সমরেশবাবু কোন কথা বলতে পারলেন না। শুধু মাথাটা উঁচু করে বসেছিলেন। আর ধনঞ্জয়বাবুর
সঙ্গীরা মাথা নিচু করে বসেছিল। ‘আদর্শ ছাত্রে’র সংজ্ঞাটা সকলের কাছে কেমন যেন
গুলিয়ে যাচ্ছিল! বুম্বা তখনও ধনঞ্জয়বাবুর রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা
করে যাচ্ছিল। অবশেষে বন্ধ হল রক্তক্ষরণ। কিন্তু ধনঞ্জয়বাবুর চোখের জলটা বলে
দিচ্ছিল, তখনও বন্ধ হয়নি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।
বি.দ্র. - স্থান, কাল, চরিত্র ও ঘটনা
সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
-শ্রী রূপেশ কুমার সামন্ত/ ২৪.০৩.১৮
No comments:
Post a Comment