-----পাঁশকুড়ার ‘সঙ্গতে’র রথযাত্রা প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো-----
@ Author- Rupesh Samanta
---পায়ে পায়ে ইতিহাসে---
অতীতের কাশিজোড়া (অধুনা পাঁশকুড়া) রাজ্যের
রাজা জিতনারায়ণ রায় সিংহাসনে আরোহন করেন ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি ২৪ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি প্রজাহিতৈশী রাজা ছিলেন। প্রজাদের মঙ্গল সাধনে কর মুকুব করতেন। ফলে তিনি নিজেই বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁকে (শাসন কাল ১৭২০-২৭)
রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হন। ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দে নবাব কতৃক কারারুদ্ধ হন। তখন রাজা জিতনারায়ণ রায়কে নানক শাহ নামে নানক পন্থী এক ফকির
প্রভাব খাটিয়ে জেল মুক্ত করেন । এরপর জিতনারায়ন নানক শাহকে নিয়ে জগন্নাথ দর্শনের উদ্যেশ্যে পুরী
চলে যান। কিন্তু তিনি জগন্নাথ দর্শনে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে
ব্যর্থতার কারন হিসাবে মনে করা হয়, মন্দির কতৃপক্ষের কাছে তার কারাগারে ‘বিধর্মী
স্পর্শ্ব দোষ’ প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। তখন সেখান থেকে জগন্নাথ দেবের মূর্তি এনে বর্তমান
দক্ষিন চাঁচিয়াড়া গ্রামে তৎকালীন পুরানো কাঁসাইএর (যা বর্তমানে মজে গেছে) তীরে ‘একটি সঙ্গত প্রস্তুত করিয়া তথায় জগন্নাথ দেবের মূর্তি স্থাপন করেন’। একই সঙ্গে আষাড়ের রথোৎসবের প্রচলন করেন। এটি বর্তমানে সঙ্গতের রথ উৎসব নামে পরিচিত। শোনা যায়,
তৎকালীন সময়ে পুরীতে রথের রশিতে টান পড়ার পর তারবার্তা এলে এখানে রথের রশিতে টান
দেওয়া হত।
---‘সঙ্গত’ নামকরণ---
‘সঙ্গত’ নামকরণ নিয়ে নানান
মত রয়েছে। ‘সঙ্গত’ শব্দের আভিধানিক
অর্থ ‘উচিৎ’ বা ‘সমীচীন’। তথ্যসূত্র অনুসারে, শিখ ধর্মে ‘সঙ্গৎ’ এর অর্থ ‘আস্থানা’। ‘আস্থানা অনেকটা অতিথিশালার মতো। অনেক দেব দেবীর আশ্রয় সেখানে’। রাজা জিতনারায়ন
রায় পুরী যাওয়ার আগে ফকির নানক শাহের কাছে শিখ ধর্ম গ্রহন করেন। ফকির নানক গুরু নানকের শিষ্য ছিলেন। ফলে ‘শিখে’র সঙ্গে ‘সঙ্গত’ যোগসূত্রেই পাওয়া যায়, ‘চাঁচিয়াড়া গ্রামে
সঙ্গত প্রস্তুত করিয়া তাহাতে জগন্নাথ দেব স্থাপন করেন’। এইভাবেই ‘সঙ্গত’ নামটি এসেছে। আরেকটি
তথ্যসূত্র অনুসারে, রাজা যেহেতু নবাবের কারাগারে বন্দী ছিলেন, তাই শুদ্ধিকরণের
জন্য জগন্নাথ দেবের মূর্তি স্থাপন ও রথযাত্রা করে সঙ্গতকর্ম করেছিলেন। তাই ঐ রথ
সঙ্গত রথ নামে পরিচিত। আরও একটি তথ্যসূত্র অনুসারে, রাজা জিতনারায়ণ রায়ের ‘বিধর্মী
সংস্পর্শ্ব’ থাকায় গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজ রাজাকে সমর্থন করেনি। তাই রাজা পুরীর
মহন্তদের দ্বারা শংসাপত্র আনিয়ে ও পুরীর একজন মহন্ত নিযুক্ত করেন জগন্নাথ দেবের
মূর্তি স্থাপন ও রথযাত্রা অনুমোদন করিয়েছিলেন। পুরীর মহন্তগন জিতনারায়ণ রায়ের জগন্নাথ
দেবের মূর্তি ও রথযাত্রাকে সেদিন ‘যথাযথ হয়েছে’ অর্থ্যাৎ ‘সঙ্গত’ হয়েছে নামে
শংসাপত্র দিয়েছিলেন বলে এই রথযাত্রা উৎসবকে সঙ্গতের রথযাত্রা বলে।
---সম্পত্তি---
সঙ্গতের জগন্নাথ দেবের
সম্পত্তি নিয়ে মতভেদ পাওয়া যায়। তথ্যসূত্র অনুসারে, রাজা জিতনারায়ণ রায় জগন্নাথ
দেবের বিগ্রহ স্থাপন করে নিত্য সেবার জন্য পুরীর মঙ্গু মঠের মহন্তদের হাতে ৩৬০
বিঘা নিস্কর জমি দান করেছিলেন। পুরীর মঙ্গুমটের মহন্তরা পর্যায়ক্রমে এখানে আসতেন। পরবর্তীকালে
তাদের নির্দেশিত পথেই স্থানীয়দের হাতে নিত্যসেবার ভার চলে যায়। অন্য একটি
তথ্যসূত্র অনুযায়ী, উড়িষ্যা থেকে নিযুক্ত জনৈক মোহান্তের হাতে জগন্নাথ দেবের
মন্দির ও রথযাত্রা উৎসর্গ করে দেন। ব্যয় নির্বাহের জন্য ১১০ বিঘা জমি দান করেন।
জমিদারি উচ্ছেদের সময় বহু জমি প্রজার নামে নথিভূক্ত হওয়ায় মন্দিরের নামে জমির
পরিমান ক্ষীণ হয়ে যায়। দেবোত্তর সম্পত্তি অধীগৃহীত হওয়ায় সরকারের বার্ষিক অনুদান
৭৬৭ টাকা ৫২ পয়সা হিসাবে স্থির হয়। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকে মহন্তরা আর সেই অনুদান
গ্রহন করেনি। মন্দির সংলগ্ন স্থানে পূর্ব দিকে একটি বড় ফাঁকা জায়গা রয়েছে। জায়গার
উত্তর পাশে মোহন্তদের সমাধিস্থল রয়েছে। আরও উত্তর দিকে মহন্ত কৃপারাম দাসের
ম্যানেজার ফকির চাঁদ পাণ্ডের সময়কালে বাংলা সন ১৩৪১ সালে নির্মিত একটি দোলমঞ্চ
রয়েছে। চাঁচিয়াড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে মহন্ত কৃপারাম দাসের উদ্যোগে
স্থাপিত হয়। উল্লেখ্য, জগন্নাথের রথ, মন্দির ইত্যাদি সম্পত্তি পুরীর মঙ্গুমঠের
হলেও তাদের আদেশক্রমে সমস্তকিছু স্থানীয় পরিচালন কমিটি কতৃক পরিচালিত হচ্ছে।
---জগন্নাথ মন্দির---
দক্ষিন চাঁচিয়াড়া গ্রামে
জগন্নাথ মন্দিরটি পূর্বমূখী ত্রিখিলান প্রবেশপথ যুক্ত। প্রবেশ পথের উপরের দেওয়ালে দশটি মূর্তি ও একট পদ্মফুলের স্থাপত্য রয়েছে। দশটি
মূর্তি হল- রাম, মৎস, বামন, বরাহ, বুদ্ধদেব, নৃসিংহ, পরশুরাম, কূর্ম্ম, কৃষ্ণ ও
কল্কি। দরজা গুলি কাঠের ফুল-লতা-পাতার নক্সা শোভিত। মন্দিরের সামনের দেওয়ালে লেখা
রয়েছে, ‘শ্রীঁ জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথ গামী ভবতুমে’। মন্দিরের সিংহাসন সহ কিছু কিছু
সংস্কার কাজ হয়েছে। মন্দিরের সামনের একটি
পস্তর ফলকে ১৭১৮ শকাব্দে (১৭৯৬ খ্রী) রাজা সুন্দর নারায়ণ রায়ের রাজত্বকালে মোহন্ত
ভক্তরাম দাসের জগন্নাথের ‘নেত উর্চ্ছব’ বা নেত্র উৎসব করার তথ্য খোদিত রয়েছে।
---মেলা-উৎসব---
আষাড় মাসে পুরীর রথযাত্রার
দিনই এখানে রথ উৎসব হয়। রথ উপলক্ষ্যে আমডুবি রথতলায় ‘মাসির বাড়ি’তে সপ্তাহব্যাপী বড় মেলাও বসে। নানান
খেলনা, মনোহারী দ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে মুখরোচক খাবার সবই পাওয়া যায়। মেলায়
জনসমাগম ভালোই হয়। আধুনিকতার যুগেও এই মেলা তার ঐতিহ্য ও কৌলিন্য নিয়ে বেঁচে রয়েছে।
@ লেখক- রূপেশ সামন্ত
[বি.দ্র.-ভালো লাগলে ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’
ও ‘শেয়ার’ করুন। ধন্যবাদ।]
তথ্যসুত্র- ১. নিজস্ব ক্ষেত্র
সমীক্ষা ২. কাশীজোড়া পরগনার রাজকাহিনী- ইন্দুভূষণ অধিকারী ৩. পরগনা কাশীজোড়া- সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য ৪.
পাঁশকুড়ার ইতিহাস (১)- বাণেশ্বর চক্রবর্তী
No comments:
Post a Comment