-- --মহালয়া ও তিন পুরুষের শ্রাদ্ধ-- ---
--- -- --দিনটি কি আদৌ শুভ?-- --- --
লেখক- রূপেশ সামন্ত
প্রতি চান্দ্রমাসে দুটি পক্ষ রয়েছে- শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ। পক্ষ ১৫ দিনের হয়। এইভাবে বছরের ১২মাসে ২৪টি পক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ২টি পক্ষ তাৎপর্য্যপূর্ণ। প্রথমটি পিতৃপক্ষ ও দ্বিতীয়টি দেবীপক্ষ। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষকে বলা হয় পিতৃপক্ষ। পিতৃপক্ষের পরের পক্ষকে বলা হয় দেবী পক্ষ। পিতৃপক্ষে স্বর্গত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ ও তর্পন করা হয়। এই সময় পিতৃলোক বা যমালোক থেকে মর্ত্যলোকে প্রয়াত পিতৃ পুরুষেরা আসেন। ফলে প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। আর এই মহালয় থেকে মহালয়া শব্দটি এসেছে। পিতৃপুরুষদের তৃপ্ত করার জন্য তিল, জল সহযোগে ‘পিণ্ড’ দান করা হয়। মহালয়া হচ্ছে পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং দেবী পক্ষ শুরুর আগের দিন।
-----রামায়ন যোগসূত্র-----
পিতৃপক্ষের শেষ দিনটি অমাবস্যা হয়। এই অমাবস্যায় পিতৃপূজা সেরে পরের পক্ষে দেবীপূজায় প্রবৃত্ত হতে হয়। পিতৃপক্ষে আত্নসংযমের মধ্য দিয়ে দেবী পক্ষে শক্তি সাধনায় উত্তীর্ণ হতে হয়। হিন্দু ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে পিতৃপুরুষদের জন্য তর্পণ করতে হয়। রামায়নে ভগবান শ্রীরামচদ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এই দিনে পিতৃ তর্পণ করেছিলেন। এরপর দেবীপক্ষে শরৎকালীন দুর্গা পূজা বা অকালবোধনে ব্রতী হয়েছিলে।
-----মহাভারত যোগসূত্র-----
মহাভারত অনুসারে, মৃত্যুর পর মহাবীর দাতা কর্ণের আত্মা পিতৃলোকে গেলে সেখানে তাঁকে শুধুই সোনা আর ধনরত্ন খেতে দেওয়া হল। কর্ণ কারণ জিজ্ঞাসা করলে যম [মতান্তরে ইন্দ্র] বললেন যে তার হাতে পিতৃপুরুষ জল পায়নি। কর্ণ কেবলই সারাজীবন সোনা ধনরত্ন বিলিয়েছেন। তাই কর্ণের জন্যে এই ব্যবস্থা। তখন কর্ণ বললেন যে তার কোন দোষ নেই। কেননা সে তার পিতৃপুরুষের কথা জানতো না। যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে মা কুন্তী তার পূর্ব পুরুষদের পরিচয় ব্যক্ত করেছিলেন। তারপর যুদ্ধে কর্ণের মৃত্যু হয়। ফলে তিনি পিতৃতর্পণের সময় পান নি। ইন্দ্র কর্ণের দোষ খুঁজে পেলেন না। তাই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন। তখন কর্ণ এক পক্ষকাল ধরে মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিলেন। তাঁর পাপস্খালন হল। সেই পক্ষটি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হল ।
----গরুড় পুরান যোগসূত্র----
মহালয়া তিথিতে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়। তারা উত্তরসূরিদের আশীর্বাদ প্রদান করেন। পিতৃপক্ষে পুত্র কর্তৃক এই তর্পণ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশ করতে পারেন। গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পুত্র ছাড়া মুক্তি নাই। গৃহস্থ দেবতা, ভূত ও অতিথিদের সঙ্গে পিতৃতর্পণের কথা বলা হয়েছে।
----মার্কণ্ডেয় পুরাণ যোগসূত্র----
মার্কেণ্ডেয় পুরানে বলা হয়েছে, পিতৃপুরুষ শ্রাদ্ধে সতুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু প্রাপ্তির আশীর্বাদ প্রদান করেন। এছাড়াও উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।
-----তিন পুরুষের শ্রাদ্ধ----
বিশ্বাস অনুযায়ী, স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে রয়েছে পিতৃলোক। এই পিতৃলোকেই রয়েছে মৃত্যুদেবতা যমরাজ। তিনিই মৃতের আত্মাকে নিয়ে যান। এই পিতৃলোকে জীবিত ব্যক্তির আগের মৃত তিন পুরুষ বাস করেন। জীবিত প্রজন্মের কারো মৃত্যু হলে সেই আত্মা পিতৃলোকে গমন করে এবং পিতৃলোক থেকে আগের প্রজন্মের একটি আত্মা স্বর্গে গমন করে। সেখানে পরমাত্মা বা ঈশ্বরে লীন হয়ে যায়। তখন তার আর শ্রাদ্ধের প্রয়োজন হয়না। তাই কোন জীবিত ব্যক্তি কেবল পূর্ববর্তী তিন পুরুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে পারে। একেই বহুক্ষেত্রে ‘তিন পুরুষের শ্রাদ্ধ’ বলা হয়। যেহেতু এই মহালয়ার সঙ্গে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধের মতো বিষয় জড়িয়ে রয়েছে তাই একে শুভদিন বলা মোটেই বাস্তব সম্মত নয়।
-----মহালয়ার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান-----
মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় নদী তীরে বা গৃহে। মৃত ব্যক্তির পুত্র বা পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী। পূর্বপুরুষকে রান্না করা খাদ্য উৎসর্গ করা হয় রুপোর পাত্র, তামার পাত্র বা কলাপাতার উপর। স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে খালি গায়ে শ্রাদ্ধ করতে হয়। শ্রাদ্ধের সময় সিদ্ধ অন্ন, ময়দা, ঘি ও তিল দিয়ে মাখিয়ে পিণ্ড তৈরী করে উৎসর্গ করা হয়। একে পিণ্ডদান বলে। শ্রাদ্ধে বিষ্ণু এবং যমের পূজা করা হয়। এই খাদ্য যদি কোনো কাক এসে খেয়ে যায়, তাহলে ধরা হয় যে খাদ্য পিতৃগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। খাদ্য গোরু ও কুকুরদেরও খাওয়ানো হয়। এরপর ব্রাহ্মণ ভোজন হয়। কাক রূপী পূর্বপুরুষের প্রতিনিধি এবং ব্রাহ্মণ ভোজনের পর অন্যান্যরা ভোজন করে।
-----সামাজিক তাৎপর্য----
মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতীত প্রজন্মকে ভুলে যায়। কিন্তু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্পর্কের সূদৃঢ বন্ধনের মধ্য দিয়েই একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার জন্মলাভ করতে পারে। এই পিতৃ তর্পণের মধ্য দিয়েই পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয়। তাঁদের নাম এবং গোত্রকে স্মরণ করা হয়। ফলে একজন ব্যক্তিকে মৃত তিন পুরুষ ও জীবিত তিন পুরুষ অর্থাৎ মোট ছয় প্রজন্মের নাম স্মরণে রাখতে হয়। এর ফলে বংশের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়। পারিবারিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এছাড়াও এর মধ্য দিয়ে পিতৃপুরুষের ঋণ স্বীকার করার নৈতিক দিকটিও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
লেখক- রূপেশ সামন্ত/ ভালো লাগলে কমেন্ট ও শেয়ার করুন। [সতর্কীকরণ- লেখাটি লেখক কতৃক সর্বসত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে লেখাটির কোন অংশ অন্যত্র প্রকাশ করা বা নকল করা সম্পূর্ণ বে-আইনী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নজরে এসেছে, এইরূপ কিছু লেখা লেখকের নাম বাদে ‘সংগৃহীত’ নামে অন্যত্র প্রকাশ হচ্ছে, যা বে-আইনী।]
তথ্যসূত্র- গরুড় পুরান, মার্কেণ্ডেয় পুরান, উইকিপিডিয়া, অষ্টাদশ পুরান সমগ্র- কামিনী প্রকাশনালয়, কৃত্তিবাসী রামায়ন, মহাভারত।
No comments:
Post a Comment