----------মহাদেবী কালী বিস্ময়ে কাটে জিভ---------
লেখক- রূপেশ কুমার সামন্ত
[আমার ‘নীল আকাশের খাতা’ বইটির কালী সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ আপনাদের সাথে শেয়ার করার মধ্য দিয়েই দিপাবলীর শুভেচ্ছা জানালাম।]
দশমহাবিদ্যার দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম দেবী হল কালী। বিভিন্ন কালীর মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় হল শ্যামা কালীর পূজা।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। এই কালীই মাতৃরূপে পূজিত হন।
-----কালীর রূপভেদ----
কালীর একাধিক রূপভেদ আমরা গ্রন্থ থেকে পাই। তোড়লতন্ত্র মতে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। এছাড়াও মহাকাল সংহিতায় নয় প্রকার, অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালী ১৩ প্রকার, জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে ১০ প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
-----দক্ষিণাকালীই হল শ্যামা কালী-----
পুরাণ বা তন্ত্র সাহিত্যে আমরা যে বিভিন্ন কালীর রূপের বর্ণনা পাই, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল দক্ষিণাকালী। দক্ষিণদিকের অধিপতি হলেন যম। কালীর ভয়ে যম সর্বদা পলায়ন করেন। তাই তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। আবার অন্যমতে, এই কালীকে ভক্তি ভরে পূজা করলে সর্বোৎকৃষ্ট ফল দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়। তাই তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। যাইহোক, এই দক্ষিনাকালীই শ্যামাকালী নামে পরিচিত।
-----শ্যামা কালীর রূপ-----
দক্ষিণাকালী বা শ্যামাকালী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালা বিভূষিতা। তাঁর একটি বাম হাতে রয়েছে নরমুণ্ড ও অন্য বাম হাতে রয়েছে খড়্গ। ডান দিকের একটি হাতে বর ও অন্য হাতে অভয় প্রদান করছেন। তাঁর গাত্রবর্ণ মেঘ বা বিপুল জলরাশির মতো নীল। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার। কোমরে নরহস্তের মালা। তাঁর দন্ত ভয়ানক, তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দক্ষিণপদ স্থাপন করে দণ্ডায়মান।
-----শ্যামা কালি পূজার ইতিহাস-----
আশ্বিন বা কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে আলোর রোশনাই এর মধ্যে শ্যামা কালীর পূজা সূচিত হয়। এই কালী পূজাকে দীপান্বিতা কালীপূজাও বলে। এই উৎসব বিপূল আড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। এই পূজা খুব বেশী অতীতের নয়। ১৭৬৮ সালে মতান্তরে ১৭৭৭ সালে কাশীনাথ রচিত শ্যামা সপর্যাবিধি গ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। জনশ্রুতি রয়েছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন।
-----পার্থিব জীবন ধারার আঙ্গিকে পর্যালোচনা-----
[১] বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র গুলি রূপকথা বা কল্প কাহিনীর মধ্য দিয়ে আমাদের বাস্তব জীবনে মূল্যবোধ, ন্যায়, সততা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। তাই পুরান, তন্ত্র ইত্যাদি পৃথিবীতে এসেছে। পুরান বা তন্ত্র থেকে আমরা যে কালী মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারি, তার মধ্য দিয়ে বাস্তবেও দুষ্টের দমন ও সত্যের জয় প্রতিষ্ঠার কথাই বলা হয়েছে। কালী মাহাত্ম্যে আসুরিক শক্তির বিনাশ, বাস্তবে অশুভ শক্তির বিনাশেরই সমান।
[২] আবার, নারী শক্তির বিপুলতার প্রকাশ ও নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বাস্তব দিকটিও কালীর মাহাত্ম্যের মধ্য দিয়েই বাস্তবে সূচিত হয়। নারী শক্তির প্রতীক মহাদেবী কালীর বিপুল শক্তিকে অবহেলা করার পরিনাম অসুরদের মুণ্ডুচ্ছেদের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়।
[৩] দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ তার সুপ্ত বিভৎসতা জাগিয়ে তুলে প্রতিরোধ করে। এখানে মহাদেবী কালীও আসুরীয় হিংস্রতার বিরুদ্ধে খড়্গ হাতে রুখে দাঁড়িয়ে বিভৎস হয়ে উঠেছিল। তাই অপরাধীর কাটা মুণ্ডু ও কাটা হাতের মালা পরিধান করা দৃশ্য, তাঁর বিভৎসতার রূপই সূচিত করে।
[৪] আবার অন্যদিকে, এই মহাদেবী কালীই মাতৃরূপে সন্তান স্নেহে আমাদের অভয় ও বর দান করেন। বাস্তব জীবনে নারীজাতির কোমলতা, স্নেহ পরায়নতা মাতৃরূপী কালীর মধ্য দিয়েই সুন্দরী ভাবে পরিস্ফুট হয়।
[৫] পাপীর দেহাংশ নিজের দেহে পরিধানের মধ্য দিয়ে সমস্ত পাপও মাহাদেবী কালী নিজের দেহেই বহন করে। বাস্তব জীবনেও সন্তানের সমস্ত পাপ মা ছাড়া আর কে বহন করতে পারে?
[৬] কালী মাহাত্ম্যেই জানতে পারি, জগতে অমঙ্গল নেমে এলে কালী তার স্বমূর্তিতে আবিভূর্ত হয় এবং অশুভ নাশ করেন। ঠিক তেমনই যখন নিজের সংসারে বা বিশ্ব-সংসারে অমঙ্গল সূচিত হয়েছে, যুগে যুগে নারী শক্তির রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে রচিত হয়েছে। প্রয়োজনে সেই নারী দৈহিক শক্তিতে বলবান পুরুষকেও শিবের মতো নিজের পদতলে আনতে দ্বিধা করে না।
-----শেষ কথা-----
যাইহোক, এই মাতৃরূপী শক্তিদায়িনী মহাদেবী কালী আর কেউ নয়, বিশ্ব সংসারে নারীর জাতির প্রতিরূপ মাত্র। আর আজকের সমাজে সেই নারী জাতির উপর নির্যাতন, অত্যাচার বড়ই নির্মম। মহাদেবী কালীই বোধহয় তাঁর তৃতীয় নয়ন বা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে যুগ যুগান্তরে নারী জাতির উপর নির্যাতন, পাপাচার আগাম দেখতে পেয়েছিলেন। আর পৃথিবীর মানব সমাজের এই করুণ দশায় হতবাক হয়েই তিনি বিস্ময়ে জিভ কেটেছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ কালিকা পুরান, উইকিপিডিয়া, সনাতন ধর্মতত্ত্ব। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।
লেখক- রূপেশ কুমার সামন্ত
[আমার ‘নীল আকাশের খাতা’ বইটির কালী সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ আপনাদের সাথে শেয়ার করার মধ্য দিয়েই দিপাবলীর শুভেচ্ছা জানালাম।]
দশমহাবিদ্যার দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম দেবী হল কালী। বিভিন্ন কালীর মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় হল শ্যামা কালীর পূজা।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। এই কালীই মাতৃরূপে পূজিত হন।
-----কালীর রূপভেদ----
কালীর একাধিক রূপভেদ আমরা গ্রন্থ থেকে পাই। তোড়লতন্ত্র মতে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী। এছাড়াও মহাকাল সংহিতায় নয় প্রকার, অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালী ১৩ প্রকার, জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে ১০ প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
-----দক্ষিণাকালীই হল শ্যামা কালী-----
পুরাণ বা তন্ত্র সাহিত্যে আমরা যে বিভিন্ন কালীর রূপের বর্ণনা পাই, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল দক্ষিণাকালী। দক্ষিণদিকের অধিপতি হলেন যম। কালীর ভয়ে যম সর্বদা পলায়ন করেন। তাই তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। আবার অন্যমতে, এই কালীকে ভক্তি ভরে পূজা করলে সর্বোৎকৃষ্ট ফল দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়। তাই তাঁর নাম দক্ষিণাকালী। যাইহোক, এই দক্ষিনাকালীই শ্যামাকালী নামে পরিচিত।
-----শ্যামা কালীর রূপ-----
দক্ষিণাকালী বা শ্যামাকালী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালা বিভূষিতা। তাঁর একটি বাম হাতে রয়েছে নরমুণ্ড ও অন্য বাম হাতে রয়েছে খড়্গ। ডান দিকের একটি হাতে বর ও অন্য হাতে অভয় প্রদান করছেন। তাঁর গাত্রবর্ণ মেঘ বা বিপুল জলরাশির মতো নীল। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার। কোমরে নরহস্তের মালা। তাঁর দন্ত ভয়ানক, তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দক্ষিণপদ স্থাপন করে দণ্ডায়মান।
-----শ্যামা কালি পূজার ইতিহাস-----
আশ্বিন বা কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে আলোর রোশনাই এর মধ্যে শ্যামা কালীর পূজা সূচিত হয়। এই কালী পূজাকে দীপান্বিতা কালীপূজাও বলে। এই উৎসব বিপূল আড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। এই পূজা খুব বেশী অতীতের নয়। ১৭৬৮ সালে মতান্তরে ১৭৭৭ সালে কাশীনাথ রচিত শ্যামা সপর্যাবিধি গ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। জনশ্রুতি রয়েছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন।
-----পার্থিব জীবন ধারার আঙ্গিকে পর্যালোচনা-----
[১] বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র গুলি রূপকথা বা কল্প কাহিনীর মধ্য দিয়ে আমাদের বাস্তব জীবনে মূল্যবোধ, ন্যায়, সততা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। তাই পুরান, তন্ত্র ইত্যাদি পৃথিবীতে এসেছে। পুরান বা তন্ত্র থেকে আমরা যে কালী মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারি, তার মধ্য দিয়ে বাস্তবেও দুষ্টের দমন ও সত্যের জয় প্রতিষ্ঠার কথাই বলা হয়েছে। কালী মাহাত্ম্যে আসুরিক শক্তির বিনাশ, বাস্তবে অশুভ শক্তির বিনাশেরই সমান।
[২] আবার, নারী শক্তির বিপুলতার প্রকাশ ও নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বাস্তব দিকটিও কালীর মাহাত্ম্যের মধ্য দিয়েই বাস্তবে সূচিত হয়। নারী শক্তির প্রতীক মহাদেবী কালীর বিপুল শক্তিকে অবহেলা করার পরিনাম অসুরদের মুণ্ডুচ্ছেদের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়।
[৩] দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ তার সুপ্ত বিভৎসতা জাগিয়ে তুলে প্রতিরোধ করে। এখানে মহাদেবী কালীও আসুরীয় হিংস্রতার বিরুদ্ধে খড়্গ হাতে রুখে দাঁড়িয়ে বিভৎস হয়ে উঠেছিল। তাই অপরাধীর কাটা মুণ্ডু ও কাটা হাতের মালা পরিধান করা দৃশ্য, তাঁর বিভৎসতার রূপই সূচিত করে।
[৪] আবার অন্যদিকে, এই মহাদেবী কালীই মাতৃরূপে সন্তান স্নেহে আমাদের অভয় ও বর দান করেন। বাস্তব জীবনে নারীজাতির কোমলতা, স্নেহ পরায়নতা মাতৃরূপী কালীর মধ্য দিয়েই সুন্দরী ভাবে পরিস্ফুট হয়।
[৫] পাপীর দেহাংশ নিজের দেহে পরিধানের মধ্য দিয়ে সমস্ত পাপও মাহাদেবী কালী নিজের দেহেই বহন করে। বাস্তব জীবনেও সন্তানের সমস্ত পাপ মা ছাড়া আর কে বহন করতে পারে?
[৬] কালী মাহাত্ম্যেই জানতে পারি, জগতে অমঙ্গল নেমে এলে কালী তার স্বমূর্তিতে আবিভূর্ত হয় এবং অশুভ নাশ করেন। ঠিক তেমনই যখন নিজের সংসারে বা বিশ্ব-সংসারে অমঙ্গল সূচিত হয়েছে, যুগে যুগে নারী শক্তির রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে রচিত হয়েছে। প্রয়োজনে সেই নারী দৈহিক শক্তিতে বলবান পুরুষকেও শিবের মতো নিজের পদতলে আনতে দ্বিধা করে না।
-----শেষ কথা-----
যাইহোক, এই মাতৃরূপী শক্তিদায়িনী মহাদেবী কালী আর কেউ নয়, বিশ্ব সংসারে নারীর জাতির প্রতিরূপ মাত্র। আর আজকের সমাজে সেই নারী জাতির উপর নির্যাতন, অত্যাচার বড়ই নির্মম। মহাদেবী কালীই বোধহয় তাঁর তৃতীয় নয়ন বা দিব্যদৃষ্টি দিয়ে যুগ যুগান্তরে নারী জাতির উপর নির্যাতন, পাপাচার আগাম দেখতে পেয়েছিলেন। আর পৃথিবীর মানব সমাজের এই করুণ দশায় হতবাক হয়েই তিনি বিস্ময়ে জিভ কেটেছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ কালিকা পুরান, উইকিপিডিয়া, সনাতন ধর্মতত্ত্ব। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।
No comments:
Post a Comment