Saturday, 13 April 2019

বাংলার চৈত্র মাসঃ বাঙালীর গাজন মাস

------- ----- ---বাংলার চৈত্রমাসঃ বাঙালীর গাজন মাস--- ----- -------
     নীল পুজোর দিন গ্রামবাংলার মহিলারা কেন নীলব্রত পালন করেন? গাজনের সন্ন্যাসীরা কেনই বা জিভে লোহার শিক গেঁথে, ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর হেঁটে, আগুনে বা বঁটির উপর ঝাঁপ দিয়ে শারীরিক কষ্ট স্বীকার করে?  কেনইবা চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে মানুষকে ঝুলিয়ে উৎসব পালন হয়? অনেক কৌতুহল। লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটু উঁকি-ঝুঁকি দিলেই কারণ গুলো জানা যায়। আসলে, গাজন একটি হিন্দু লোকউৎসব। কিন্তু গাজন উৎসব কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত গাজন মেলায় সর্ব-ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান এক সার্বজনীন রূপ নেয়। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। ছড়া গানের মধ্যেও রয়েছে শিবের গাজন- ‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই।/ ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।’ গাজন উৎসবের মূলত তিনটি অংশ— ঘাট-সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক।
-----ঘাট-সন্ন্যাস-----
     অতীতে চৈত্রের প্রথম দিন থেকেই ভক্তরা সন্ন্যাস পালন করতেন। বর্তমানে চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে, কোথাও বা তিন দিন আগে থেকে কঠোর নিয়ম নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঘাট-সন্ন্যাস পালন করা হয়। ঐ ক’দিনের সন্ন্যাস পালন অত্যন্ত কঠিন। গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করতে হয়। ব্রতধারী সন্ন্যসীদের হবিষ্যি গ্রহণ করতে হয়। এক জন প্রধান সন্ন্যাসী থাকেন। এখন অনেক মহিলারাও সন্ন্যাসিনী হন। যাইহোক, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গাজন উৎসব এর আঞ্চলিক বৈচিত্র বেশ লক্ষ্যনীয়। সন্ন্যাসীদের মুখোশ নৃত্য আর সঙ সাজা একটি অন্যতম দিক। সন্ন্যাসীরা শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সঙ সেজে নৃত্য করতে থাকেন। নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করতে থাকেন। ব্রতধারী সন্ন্যসীরা শিবের পুজোর ফুল গ্রহণ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গ নিয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাজনা বাজিয়ে গ্রাম পরিক্রমায় বের হন। মুখোশ নৃত্যে ফুটে ওঠে পৌরানিক গল্পের নানা চরিত্র, দেব-দেবী, রাক্ষস, পশু ইত্যাদি। গাজনের সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রনা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও হয় কালীনাচ। কালী সেজে, মুখোশ পরে নাচকে বলা হয় কালীনাচ। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে হয়। এই উৎসবের সঙ্গে মেলা অপরিহার্য।
-----নীল পূজা-----
     নীল পূজা পালিত হয় গাজনের পরের দিন তথা চড়কের আগের দিন। বাঙালি গৃহিণীরা নিজের সন্তান এর মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠীর ব্রত পালন করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন। জনশ্রুতি অনুসারে, এক বামনী অতি ভক্তি সহকরে সমস্ত ব্রত করতেন। কিন্তু তাঁর একটিও ছেলে মেয়ে বাঁচতো না। তারপর মনের দুঃখে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কাশী চলে যান। একদিন কাশীতে যখন ঘাটের ওপর বসে মনের দুঃখে কাঁদছিলেন, তখন মা ষষ্ঠী বুড়ি বামনীর বেশ ধরে এসে তাদের জিজ্ঞেস করেন, “কাঁদছিস কেন?” বামনী বললে, “আমার পাঁচটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল, কিন্তু সব ক’টাই মরে গেল। সব বার–ব্রত, ঠাকুর দেবতা মিথ্যে।” মা ষষ্ঠী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোরা কি নীল ষষ্ঠী করেছিস?” বামনী বললে, “ও ব্রত তো আমি জানি না।” তখন মা ষষ্ঠী বললেন, “সমস্ত চৈত্র মাস সন্ন্যাস করে শিব পুজো করবে, তারপর সংক্রান্তির আগের দিন উপোষ করে সন্ধ্যার সময় নীলকণ্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিয়ে, মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে তবে জল খাবে।” এই কথা বলে মা ষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপর বামনী দেশে ফিরে গিয়ে খুব ভাল করে নীল ষষ্ঠীর পুজো করল। এরপর তাদের যতগুলো ছেলেমেয়ে হল, সবাই বেঁচে রইল। ব্রত-আচার অনুযায়ী, গৃহিনীরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যায় শিবের মাথায় পাঁচটি আকন্দ ফুল, সিদ্ধি, গাঁজা, দুধ মিশ্রিত গঙ্গাজল ঢেলে ঘীয়ের প্রদীপ জ্বেলে শিবকে প্রনাম করে জল খায়। এ দিন গাজনের সন্ন্যাসীদের ফল, আতপ চাল, অর্থ দান করা হয়। রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা উপোষ থাকেন। পরদিন বিকেলে চড়ক পূজা শেষেই উপোষ ভাঙেন তারা।
-----চড়ক পূজা-----
      চৈত্র মাসের শেষ দিনে উদ্‌যাপিত হয় চড়ক উৎসব। সারা বছর ধরে চড়ক গাছকে শিবমন্দিরের কাছের কোনও পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। সেই পুকুর ‘শিবপুকুর’ নামে পরিচিত। চড়কের দিন গাছটিকে তুলে আনা হয় মন্দিরের সামনে। তার পর, চড়কগাছ পুজো করে তা মাঠের মাঝে পোঁতা হয়। এর পরে শুরু হয় চড়ক অনুষ্ঠান। সঙ্গে চলে বিরাট মেলা। চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে সন্ন্যাসীকে ঝুলিয়ে দিয়ে ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়ানো হয়। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্ন্যাসী নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে ছুড়ে দেন বাতাসা, ফল ইত্যাদি। সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদেরও শূন্যে তুলে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন। সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস, জগতে যারা শিব ঠাকুরের কৃপা লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছে, বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
-----গাজনের ইতিহাস-----
১. গবেষকদের মতে, ‘গাজন’ শব্দটি ‘গর্জন’ শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের নাম গাজন। অন্য গবেষকদের মতে, ‘গা’ শব্দের অর্থ ‘গ্রাম’ এবং ‘জন’ শব্দের অর্থ ‘জনগন’। গ্রামীণ জনগনের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের নাম গাজন।
২. বিশ্বাস মতে, গাজন উৎসবের সময় দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। সন্ন্যাসীরা ঐ উৎসবে বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন।
৩. গাজন নিয়ে ভারতকোষকার বলেছেন, “… প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।”
৪. আবার অন্যমতে, নিজেদের কে যন্ত্রণা দিয়ে আমরা অনুভব করার চেষ্টা করি যে, এই পৃথিবীটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সুখের সঙ্গে দুঃখকে গ্রহণ করতে পারলে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায়। তাই হয়তো শরীর কে যন্ত্রনা দিয়ে এই উৎসব পালন করার রেওয়াজ তৈরী হয়েছে।
৫. গাজন সূত্রপাতের দিনক্ষন বলা মুশকিল। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন কমে এসেছিল, তখন কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে হিন্দু ধর্মের সাথে কিছু বৌদ্ধ তন্ত্র মন্ত্রের মিশ্রন হয়। এই তান্ত্রিক ক্রিয়া থেকেই সৃষ্টি হয় চড়ক পুজোর। সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্টবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যান। পিঠে বঁড়শি গাঁথা, দড়ি দিয়ে আগুনে উপর ঝুলিয়ে দেওয়া, জিভে বা শরীরের কোনও জায়গায় লোহার শিক গেঁথে দেওয়া বা ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি কষ্ট স্বীকার তারই অঙ্গ।
৬. গাজন সূত্রপাতের দিনক্ষন নিয়ে লোককথায় শোনা যায় নানা কাহিনি। শোনা যায়, বান রাজা শিবকে তুষ্ট করতে কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্য দিয়ে তপস্যা করেছিলেন। শিবভক্তির সেই সূত্র ধরেই চড়কের সন্ন্যাসীরা আজও বান ফোঁড়ান, নানা ধরনের ঝাঁপ দেন। আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, ঝুলঝাঁপ ইত্যাদি তারই অঙ্গ। বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে গাজনে নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্যের প্রচলন আছে।
৭. যদিও প্রথমে গাজন উৎসব নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরবর্তীতে ১৪৮৫ সালে উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন শুরু করেন সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা। এ পূজার অপর নাম নীল পূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের।
৮. ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে গাজনের নামে ‘শারিরীক নির্যাতন’ প্রথা বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
[পৌরানিক কাহিনী ভিত্তিক রচনা/ লেখক- রূপেশ সামন্ত/ ০৫.০৪.২০১৮]

Monday, 1 April 2019

ছোট গল্প- শ্লেট


শ্লেট

[প্রকাশিত- নীল আকাশের খাতা]

 লেখক- রূপেশ কুমার সামন্ত


          'চা এর এই গরম জলই আজ গায়ে ঢালব! একবার ঘুম থেকে উঠুক! ছেলেটা কি আমার একার নাকি! আজ আমি আর গার্ডিয়ান মিটিংয়ে যাচ্ছি না!' স্বগতোক্তি করতে করতে রাগে টগবগ করে ফুটছিল দিদিমনি। সকাল বেলায় গ্যাস ওভেনে চা'য়ের জন্য জলটাও ফুটছিল টগবগ করে। দিদিমনির নাম মেঘা রায়। স্বামীও শিক্ষক। নাম সুতনু রায়। শিক্ষক দম্পতি শহরের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। তাদের একটি ছয় বছরের ছেলেও রয়েছে। সে বিগত দু'বছর ধরে স্কুলে যাচ্ছে। সে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়েগতকাল রেজাল্ট আউট হয়েছে। আজ অভিভাবক সাক্ষাতে ছাত্রদের খাতা দেখানো হবে।
         রান্নাঘরের পাশের রুমে তখনও শুয়ে আছে সুতনু। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলেন, আজ আর চা খাওয়া হল না!
         চুপি চুপি উঠলেন সুতনু বাবু। মনে মনে ভাবলেন, গৃহশান্তি আগে! প্রাপ্য ছুটির বলিদান দেওয়াই ভালো! লুকিয়ে ফোন করলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষককে। ছুটিটা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করলেন।
          সুতনু বাবু স্ত্রীকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘মেঘা, আজ আমি অম্বরের স্কুলের গার্ডিয়ান মিটিংয়ে যাবোদিদিমনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকলো। রাগ এতো সহজে কমার নয়! রণমূর্তি ধারণ করে বলল, ‘আমি কি একাই ওর পড়ানোর জমিদারি নিয়ে রেখেছি। বাবার তো কোন দায় দায়িত্ব নেই! পাশের ফ্ল্যাটের ইশিতাদির মেয়ে রিকা এবারেও ফার্স্ট হয়েছে। তার বাবা-মা দুজনে মিলে পড়ায়। তাহলে আমার ছেলের রোল দশ হবে না তো কি এক হবে!’
          এতক্ষণে সুতনু বুঝতে পারল দিদিমনির রাগের কারনটা। সংসারের শান্তি রক্ষায় সুতনু চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলরেডি হয়ে সুতনু ছেলেকে নিয়ে স্কুলের দিকে রওয়ানা হল।
          স্কুলের একটি হল ঘরের মধ্যে সভা শুরু হল। সেখানে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক-অভিভাবিকা ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপস্থিত। প্রধান শিক্ষিকার দীর্ঘ উপদেশ বানী কিছুক্ষণ চলল।
          এরপর ডাক পড়ল রিকা রায়ের। সঙ্গে মা ইশিতা রায়। প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ‘আপনার মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হলেও রেজাল্ট ভালো হয়নি। অন্য সাবজেক্ট গুলোতে ফুল মার্কস পেলেও ইংলিশে পঁচিশের চব্বিশ পেয়েছে। এক কম পেয়েছে। ওকে একটু চাপ দিন। প্র্যাকটিসটা বেশি করে করান। এতো কম পড়াশোনা করলে হবে না
          ইশিতা দেবী রিকার পিঠে ঠাস ঠাস করে মারতে লাগলেনকেন এক নম্বর কম পেলি বল। তোর আজ খাওয়াই বন্ধইশিতা দেবী রাগত ভাবে বলে চললেন।
          সুতনু চুপ থাকতে পারলেন না। ইশিতা দেবীকে থামিয়ে বললেন, ‘ওকে এভাবে মারবেন না। ও তো শিশু! পরীক্ষাটাই কি জিনিস ও তো বোঝে না! তাছাড়া এখানে ওর বন্ধুরাও রয়েছে। দেখুন, বেচারীর কেমন লজ্জায় ভয়ে মুখটা লাল হয়ে গেছে!’
          ইশিতা দেবী এবার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, 'দেখুন সুতনু বাবু, এই সময়টাই ওকে মানুষ করার বয়স। খেলাধুলার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে'বৃথা বাক্যব্যয় ভেবে সুতনু বাবু চুপ করে গেলেন।
          এরপর ইশিতা দেবী ব্যাগ থেকে একটা শ্লেট বের করলেন। সেটি প্রধান শিক্ষিকাকে দেখিয়ে বললেন, 'বাড়িতে ওকে এতো প্র‍্যাক্টিস করাই যে, খাতার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তাই শেষে একটা শ্লেট কিনলাম। দেখুন, ওকে এত প্র‍্যাক্টিস করিয়েছি যে শ্লেটটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেছে! আর কি করলে হবে বলুন তো?'
          প্রধান শিক্ষিকা বললেন, 'বা! দারুন আইডিয়া! ওকে শ্লেটেই আরো বেশি করে প্র‍্যাক্টিস করান'
          এরপর আরো কিছু অভিভাকের সঙ্গে কথা বলার পর এলো সুতনু বাবুর পালা। প্রধান শিক্ষিকা বললেন, 'আপনার ছেলের তো পজিশন দশ হয়েছে। ওর প্রতিটা বিষয়ে তিন চার নম্বর করে কম আছে। বাড়িতে বেশি করে প্র‍্যাক্টিস করান। পড়াশোনায় একটু চাপ দিন'
          সুতনু বাবু বিনীতভাবে বললেন, 'ম্যাম, কি চাপ দিই বলুন তো! ঐটুকু ছেলের ঐ ছোট্ট দেহটা কি চাপ সইতে পারবে? ওর মনটাও তো এখনও ততটা বড় হয় নি, যে এতটা চাপ নিতে পারবে!'
          প্রধান শিক্ষিকা বলে উঠলেন, 'ছেলেকে মানুষ করতে চাইলে পড়াশোনার চাপ তো দিতেই হবে'
           'হুম, মানুষ করতেই তো চাই। কিন্তু চাপ নেওয়ার মতো শরীর আর মনটা তৈরি হোক। সারা জীবন তো ওকে চাপ বইতে হবে! ওকেই ওর লড়াই লড়তে হবে! এখন ওর শৈশবটা একটু উপভোগ করুক না! মন আর শরীরের বিকাশ হয়ে গেলে দেখবেন দু'বছরের পড়া দু'মাসেই শিখে ফেলেছেওর শ্লেটটা এখন খালিই থাক! পরে প্র‍্যাক্টিসের জন্য জায়গা তো রাখতে হবে!' গড়গড়িয়ে বলে গেলেন সুতনু বাবু।
          বেগতিক বুঝে প্রধান শিক্ষিকা আর কথা বাড়ালেন না। দ্রুত সভা শেষ করে দিলেন।
          সুতনু বাবু বাড়ি ফিরতে ফিরতে ছেলে অম্বরকে বলল, 'কিরে পরীক্ষায় তো ভালই রেজাল্ট করলি। যাবি নাকি রেষ্টুরেন্টে?'
          'কিন্তু মা তো রেগে আছে। রিকা ফার্স্ট হয়েছে। আমি হতে পারিনি। মাকে আমার ভয় লাগে। আমার পড়তেই ইচ্ছে করছে না আর!' অম্বর তার বাবাকে বলল।
           'দুর বোকা ছেলে! মাকে জড়িয়ে ধরে একটা হামি খেয়ে নিবি। দেখবি মায়ের সব রাগ চলে যাবে! আর রিকা ফার্স্ট হয়েছে তো কি হয়েছে! তুই কারো সাথে তুলনা করিস না! তুই তোর মতো করে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিস'সুতনু ছেলেকে বলল।
           'তুমি আমার খুব খুব ভালো বাবা! আমি তো ভালো রেজাল্ট করেছি! তাহলে আমায় একটা গিফট দেবে?' অম্বর বলল।
          'কি বল?' সুতনু বলল।
          'আমায় আজ মাঠে খেলতে নিয়ে যাবে? আমার রিকার সঙ্গে খেলতে খুব ইচ্ছে করে। রিকাও খেলতে চায়। ওর মা ওকে খেলতে দেয় না'
          চোখটা ছলছল করে উঠল সুতনুর। সে বলল, 'হ্যাঁ, তুই রোজ খেলতে যাবি। খেলবি বেশি করে, আর ইচ্ছে হলে পড়বি' তারা রেস্টুরেন্টে গেল। খাবারের চারটি পার্সেল নিল। অম্বর বলল, 'বাবা, আমরা তো তিনজন! চারটে পার্সেল কি হবে?''
         সুতনু বলল, 'তোর বন্ধু রিকাকে তার মা আজ খেতে দেবে না বলেছে। ওকে একটা পার্সেল লুকিয়ে দিয়ে আসবি' অম্বর খুব খুশি হল। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল।
        পরের বছর ক্লাস টু’য়ের রেজাল্ট বের হল। রিকা ক্লাসে থার্ড হল। আর অম্বরের পজিশন এইট। অভিভাবক সভায় সুতনু বাবু উপস্থিত হল। সভায় রিকার মা যথারীতি রিকার পিঠে বেশ কয়েক ঘা দিল। শাস্তিও ঘোষণা করল রিকার দু'দিন খাওয়া বন্ধ। সেই সঙ্গে শ্লেটটাও দেখাতে ভূললেন না! পার্থক্যটা চোখে দেখা গেল। লিখতে লিখতে শ্লেটটা আগের চেয়ে অনেক অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
          বাড়ি ফেরার পথে সুতনু বাবু ছেলেকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। এবারে পাঁচটা পার্সেল নিল। অম্বরের কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সুতনু বললেন, ‘তিনটে পার্সেল আমাদের জন্য। রিকার দুদিন খাওয়া বন্ধ। ওকে দুটো পার্সেল লুকিয়ে দিস। একটা ড্রাই ফুড আছে’। এবার অম্বর বলল, ‘আর আমার গিফট?’
          সুতনু বলল, ‘আজকে তোর সঙ্গে ডাবল টাইম খেলব এটাই তোর গিফট’।
         ‘আই লাভ ইউ বাবা!’ বলেই অম্বর বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরল। সুতনু বাবুর চোখের জল এসে গেল।
         কিন্তু মেঘা দিদিমনি ছেলেকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। ছেলের প্রতি বাবার ‘উদাসীনতা’ তাকে যেন আরও রুষ্ট করে তুলেছে। সংসারের শান্তি রক্ষায় সুতনু বাবু বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছেন। শুধু অদৃশ্য ভাবে রক্ষা করে চলেন ছেলে অম্বরকে
        এই ভাবেই দু’বছর কেটে গেল। ক্লাস ফোরের রেজাল্ট আউট হয়েছে। এবার রিকা ক্লাসে টেন পজিশন পেয়েছে। আর অম্বর ক্লাসে ফার্স্ট। অভিভাবক সভায় সবাই হাজির। প্রধান শিক্ষিকার দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে শুরু হল সভা।
        সভার শুরুতেই ইশিতা দেবী উদভ্রান্তের মতো ব্যাগ থেকে শ্লেটটা বেরঙ্করতে করতে বললেন, ‘কেন এমন হল বলতে পারেন? যে মেয়েটা ফার্স্ট হত, সে আজ পিছতে পিছতে দশ! এরপর তো ফেল করবে! এই দেখুন শ্লেটটা। এতো প্র্যাক্টিস করিয়েছি যে, শ্লেটটা আর স্পষ্ট দেখাও যায় না।  কালো শ্লেট সাদা হয়ে গেছে! আর কত প্র্যাক্টিস করাবো?’
         সুতনু বাবু নিস্পাপ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল। মানুষ হতে গিয়ে রিকার অবস্থাটা দেখে চোখটা ছলছল করে উঠল সুতনুর। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে উঠে শুধু বললেন, ‘শ্লেটটা তো শৈশবেই ভরিয়ে ফেলেছেন। একটুও খালি রাখেন নি! প্র্যাক্টিস করবে কোথায়?’

০৫.০৮.১৮

জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

  জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল? জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠি...