------- ----- ---বাংলার চৈত্রমাসঃ বাঙালীর গাজন মাস--- ----- -------
নীল পুজোর দিন গ্রামবাংলার মহিলারা কেন নীলব্রত পালন করেন? গাজনের সন্ন্যাসীরা কেনই বা জিভে লোহার শিক গেঁথে, ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর হেঁটে, আগুনে বা বঁটির উপর ঝাঁপ দিয়ে শারীরিক কষ্ট স্বীকার করে? কেনইবা চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে মানুষকে ঝুলিয়ে উৎসব পালন হয়? অনেক কৌতুহল। লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটু উঁকি-ঝুঁকি দিলেই কারণ গুলো জানা যায়। আসলে, গাজন একটি হিন্দু লোকউৎসব। কিন্তু গাজন উৎসব কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত গাজন মেলায় সর্ব-ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান এক সার্বজনীন রূপ নেয়। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। ছড়া গানের মধ্যেও রয়েছে শিবের গাজন- ‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই।/ ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।’ গাজন উৎসবের মূলত তিনটি অংশ— ঘাট-সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক।
-----ঘাট-সন্ন্যাস-----
অতীতে চৈত্রের প্রথম দিন থেকেই ভক্তরা সন্ন্যাস পালন করতেন। বর্তমানে চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে, কোথাও বা তিন দিন আগে থেকে কঠোর নিয়ম নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঘাট-সন্ন্যাস পালন করা হয়। ঐ ক’দিনের সন্ন্যাস পালন অত্যন্ত কঠিন। গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করতে হয়। ব্রতধারী সন্ন্যসীদের হবিষ্যি গ্রহণ করতে হয়। এক জন প্রধান সন্ন্যাসী থাকেন। এখন অনেক মহিলারাও সন্ন্যাসিনী হন। যাইহোক, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গাজন উৎসব এর আঞ্চলিক বৈচিত্র বেশ লক্ষ্যনীয়। সন্ন্যাসীদের মুখোশ নৃত্য আর সঙ সাজা একটি অন্যতম দিক। সন্ন্যাসীরা শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সঙ সেজে নৃত্য করতে থাকেন। নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করতে থাকেন। ব্রতধারী সন্ন্যসীরা শিবের পুজোর ফুল গ্রহণ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গ নিয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাজনা বাজিয়ে গ্রাম পরিক্রমায় বের হন। মুখোশ নৃত্যে ফুটে ওঠে পৌরানিক গল্পের নানা চরিত্র, দেব-দেবী, রাক্ষস, পশু ইত্যাদি। গাজনের সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রনা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও হয় কালীনাচ। কালী সেজে, মুখোশ পরে নাচকে বলা হয় কালীনাচ। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে হয়। এই উৎসবের সঙ্গে মেলা অপরিহার্য।
-----নীল পূজা-----
নীল পূজা পালিত হয় গাজনের পরের দিন তথা চড়কের আগের দিন। বাঙালি গৃহিণীরা নিজের সন্তান এর মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠীর ব্রত পালন করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন। জনশ্রুতি অনুসারে, এক বামনী অতি ভক্তি সহকরে সমস্ত ব্রত করতেন। কিন্তু তাঁর একটিও ছেলে মেয়ে বাঁচতো না। তারপর মনের দুঃখে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কাশী চলে যান। একদিন কাশীতে যখন ঘাটের ওপর বসে মনের দুঃখে কাঁদছিলেন, তখন মা ষষ্ঠী বুড়ি বামনীর বেশ ধরে এসে তাদের জিজ্ঞেস করেন, “কাঁদছিস কেন?” বামনী বললে, “আমার পাঁচটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল, কিন্তু সব ক’টাই মরে গেল। সব বার–ব্রত, ঠাকুর দেবতা মিথ্যে।” মা ষষ্ঠী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোরা কি নীল ষষ্ঠী করেছিস?” বামনী বললে, “ও ব্রত তো আমি জানি না।” তখন মা ষষ্ঠী বললেন, “সমস্ত চৈত্র মাস সন্ন্যাস করে শিব পুজো করবে, তারপর সংক্রান্তির আগের দিন উপোষ করে সন্ধ্যার সময় নীলকণ্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিয়ে, মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে তবে জল খাবে।” এই কথা বলে মা ষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপর বামনী দেশে ফিরে গিয়ে খুব ভাল করে নীল ষষ্ঠীর পুজো করল। এরপর তাদের যতগুলো ছেলেমেয়ে হল, সবাই বেঁচে রইল। ব্রত-আচার অনুযায়ী, গৃহিনীরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যায় শিবের মাথায় পাঁচটি আকন্দ ফুল, সিদ্ধি, গাঁজা, দুধ মিশ্রিত গঙ্গাজল ঢেলে ঘীয়ের প্রদীপ জ্বেলে শিবকে প্রনাম করে জল খায়। এ দিন গাজনের সন্ন্যাসীদের ফল, আতপ চাল, অর্থ দান করা হয়। রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা উপোষ থাকেন। পরদিন বিকেলে চড়ক পূজা শেষেই উপোষ ভাঙেন তারা।
-----চড়ক পূজা-----
চৈত্র মাসের শেষ দিনে উদ্যাপিত হয় চড়ক উৎসব। সারা বছর ধরে চড়ক গাছকে শিবমন্দিরের কাছের কোনও পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। সেই পুকুর ‘শিবপুকুর’ নামে পরিচিত। চড়কের দিন গাছটিকে তুলে আনা হয় মন্দিরের সামনে। তার পর, চড়কগাছ পুজো করে তা মাঠের মাঝে পোঁতা হয়। এর পরে শুরু হয় চড়ক অনুষ্ঠান। সঙ্গে চলে বিরাট মেলা। চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে সন্ন্যাসীকে ঝুলিয়ে দিয়ে ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়ানো হয়। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্ন্যাসী নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে ছুড়ে দেন বাতাসা, ফল ইত্যাদি। সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদেরও শূন্যে তুলে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন। সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস, জগতে যারা শিব ঠাকুরের কৃপা লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছে, বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
-----গাজনের ইতিহাস-----
১. গবেষকদের মতে, ‘গাজন’ শব্দটি ‘গর্জন’ শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের নাম গাজন। অন্য গবেষকদের মতে, ‘গা’ শব্দের অর্থ ‘গ্রাম’ এবং ‘জন’ শব্দের অর্থ ‘জনগন’। গ্রামীণ জনগনের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের নাম গাজন।
২. বিশ্বাস মতে, গাজন উৎসবের সময় দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। সন্ন্যাসীরা ঐ উৎসবে বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন।
৩. গাজন নিয়ে ভারতকোষকার বলেছেন, “… প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।”
৪. আবার অন্যমতে, নিজেদের কে যন্ত্রণা দিয়ে আমরা অনুভব করার চেষ্টা করি যে, এই পৃথিবীটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সুখের সঙ্গে দুঃখকে গ্রহণ করতে পারলে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায়। তাই হয়তো শরীর কে যন্ত্রনা দিয়ে এই উৎসব পালন করার রেওয়াজ তৈরী হয়েছে।
৫. গাজন সূত্রপাতের দিনক্ষন বলা মুশকিল। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন কমে এসেছিল, তখন কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে হিন্দু ধর্মের সাথে কিছু বৌদ্ধ তন্ত্র মন্ত্রের মিশ্রন হয়। এই তান্ত্রিক ক্রিয়া থেকেই সৃষ্টি হয় চড়ক পুজোর। সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্টবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যান। পিঠে বঁড়শি গাঁথা, দড়ি দিয়ে আগুনে উপর ঝুলিয়ে দেওয়া, জিভে বা শরীরের কোনও জায়গায় লোহার শিক গেঁথে দেওয়া বা ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি কষ্ট স্বীকার তারই অঙ্গ।
৬. গাজন সূত্রপাতের দিনক্ষন নিয়ে লোককথায় শোনা যায় নানা কাহিনি। শোনা যায়, বান রাজা শিবকে তুষ্ট করতে কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্য দিয়ে তপস্যা করেছিলেন। শিবভক্তির সেই সূত্র ধরেই চড়কের সন্ন্যাসীরা আজও বান ফোঁড়ান, নানা ধরনের ঝাঁপ দেন। আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, ঝুলঝাঁপ ইত্যাদি তারই অঙ্গ। বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে গাজনে নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্যের প্রচলন আছে।
৭. যদিও প্রথমে গাজন উৎসব নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরবর্তীতে ১৪৮৫ সালে উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন শুরু করেন সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা। এ পূজার অপর নাম নীল পূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের।
৮. ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে গাজনের নামে ‘শারিরীক নির্যাতন’ প্রথা বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
[পৌরানিক কাহিনী ভিত্তিক রচনা/ লেখক- রূপেশ সামন্ত/ ০৫.০৪.২০১৮]
নীল পুজোর দিন গ্রামবাংলার মহিলারা কেন নীলব্রত পালন করেন? গাজনের সন্ন্যাসীরা কেনই বা জিভে লোহার শিক গেঁথে, ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর হেঁটে, আগুনে বা বঁটির উপর ঝাঁপ দিয়ে শারীরিক কষ্ট স্বীকার করে? কেনইবা চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে মানুষকে ঝুলিয়ে উৎসব পালন হয়? অনেক কৌতুহল। লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসে একটু উঁকি-ঝুঁকি দিলেই কারণ গুলো জানা যায়। আসলে, গাজন একটি হিন্দু লোকউৎসব। কিন্তু গাজন উৎসব কে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত গাজন মেলায় সর্ব-ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান এক সার্বজনীন রূপ নেয়। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। ছড়া গানের মধ্যেও রয়েছে শিবের গাজন- ‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই।/ ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।’ গাজন উৎসবের মূলত তিনটি অংশ— ঘাট-সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক।
-----ঘাট-সন্ন্যাস-----
অতীতে চৈত্রের প্রথম দিন থেকেই ভক্তরা সন্ন্যাস পালন করতেন। বর্তমানে চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে, কোথাও বা তিন দিন আগে থেকে কঠোর নিয়ম নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঘাট-সন্ন্যাস পালন করা হয়। ঐ ক’দিনের সন্ন্যাস পালন অত্যন্ত কঠিন। গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করতে হয়। ব্রতধারী সন্ন্যসীদের হবিষ্যি গ্রহণ করতে হয়। এক জন প্রধান সন্ন্যাসী থাকেন। এখন অনেক মহিলারাও সন্ন্যাসিনী হন। যাইহোক, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গাজন উৎসব এর আঞ্চলিক বৈচিত্র বেশ লক্ষ্যনীয়। সন্ন্যাসীদের মুখোশ নৃত্য আর সঙ সাজা একটি অন্যতম দিক। সন্ন্যাসীরা শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সঙ সেজে নৃত্য করতে থাকেন। নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করতে থাকেন। ব্রতধারী সন্ন্যসীরা শিবের পুজোর ফুল গ্রহণ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গ নিয়ে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাজনা বাজিয়ে গ্রাম পরিক্রমায় বের হন। মুখোশ নৃত্যে ফুটে ওঠে পৌরানিক গল্পের নানা চরিত্র, দেব-দেবী, রাক্ষস, পশু ইত্যাদি। গাজনের সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রনা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও হয় কালীনাচ। কালী সেজে, মুখোশ পরে নাচকে বলা হয় কালীনাচ। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে হয়। এই উৎসবের সঙ্গে মেলা অপরিহার্য।
-----নীল পূজা-----
নীল পূজা পালিত হয় গাজনের পরের দিন তথা চড়কের আগের দিন। বাঙালি গৃহিণীরা নিজের সন্তান এর মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠীর ব্রত পালন করে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন। জনশ্রুতি অনুসারে, এক বামনী অতি ভক্তি সহকরে সমস্ত ব্রত করতেন। কিন্তু তাঁর একটিও ছেলে মেয়ে বাঁচতো না। তারপর মনের দুঃখে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কাশী চলে যান। একদিন কাশীতে যখন ঘাটের ওপর বসে মনের দুঃখে কাঁদছিলেন, তখন মা ষষ্ঠী বুড়ি বামনীর বেশ ধরে এসে তাদের জিজ্ঞেস করেন, “কাঁদছিস কেন?” বামনী বললে, “আমার পাঁচটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল, কিন্তু সব ক’টাই মরে গেল। সব বার–ব্রত, ঠাকুর দেবতা মিথ্যে।” মা ষষ্ঠী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোরা কি নীল ষষ্ঠী করেছিস?” বামনী বললে, “ও ব্রত তো আমি জানি না।” তখন মা ষষ্ঠী বললেন, “সমস্ত চৈত্র মাস সন্ন্যাস করে শিব পুজো করবে, তারপর সংক্রান্তির আগের দিন উপোষ করে সন্ধ্যার সময় নীলকণ্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিয়ে, মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে তবে জল খাবে।” এই কথা বলে মা ষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তারপর বামনী দেশে ফিরে গিয়ে খুব ভাল করে নীল ষষ্ঠীর পুজো করল। এরপর তাদের যতগুলো ছেলেমেয়ে হল, সবাই বেঁচে রইল। ব্রত-আচার অনুযায়ী, গৃহিনীরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যায় শিবের মাথায় পাঁচটি আকন্দ ফুল, সিদ্ধি, গাঁজা, দুধ মিশ্রিত গঙ্গাজল ঢেলে ঘীয়ের প্রদীপ জ্বেলে শিবকে প্রনাম করে জল খায়। এ দিন গাজনের সন্ন্যাসীদের ফল, আতপ চাল, অর্থ দান করা হয়। রাতে নীল পূজার পর সন্ন্যাসীরা উপোষ থাকেন। পরদিন বিকেলে চড়ক পূজা শেষেই উপোষ ভাঙেন তারা।
-----চড়ক পূজা-----
চৈত্র মাসের শেষ দিনে উদ্যাপিত হয় চড়ক উৎসব। সারা বছর ধরে চড়ক গাছকে শিবমন্দিরের কাছের কোনও পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। সেই পুকুর ‘শিবপুকুর’ নামে পরিচিত। চড়কের দিন গাছটিকে তুলে আনা হয় মন্দিরের সামনে। তার পর, চড়কগাছ পুজো করে তা মাঠের মাঝে পোঁতা হয়। এর পরে শুরু হয় চড়ক অনুষ্ঠান। সঙ্গে চলে বিরাট মেলা। চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে সন্ন্যাসীকে ঝুলিয়ে দিয়ে ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়ানো হয়। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্ন্যাসী নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে ছুড়ে দেন বাতাসা, ফল ইত্যাদি। সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদেরও শূন্যে তুলে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন। সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস, জগতে যারা শিব ঠাকুরের কৃপা লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছে, বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
-----গাজনের ইতিহাস-----
১. গবেষকদের মতে, ‘গাজন’ শব্দটি ‘গর্জন’ শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের নাম গাজন। অন্য গবেষকদের মতে, ‘গা’ শব্দের অর্থ ‘গ্রাম’ এবং ‘জন’ শব্দের অর্থ ‘জনগন’। গ্রামীণ জনগনের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের নাম গাজন।
২. বিশ্বাস মতে, গাজন উৎসবের সময় দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। সন্ন্যাসীরা ঐ উৎসবে বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন।
৩. গাজন নিয়ে ভারতকোষকার বলেছেন, “… প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।”
৪. আবার অন্যমতে, নিজেদের কে যন্ত্রণা দিয়ে আমরা অনুভব করার চেষ্টা করি যে, এই পৃথিবীটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সুখের সঙ্গে দুঃখকে গ্রহণ করতে পারলে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায়। তাই হয়তো শরীর কে যন্ত্রনা দিয়ে এই উৎসব পালন করার রেওয়াজ তৈরী হয়েছে।
৫. গাজন সূত্রপাতের দিনক্ষন বলা মুশকিল। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন কমে এসেছিল, তখন কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ফলে হিন্দু ধর্মের সাথে কিছু বৌদ্ধ তন্ত্র মন্ত্রের মিশ্রন হয়। এই তান্ত্রিক ক্রিয়া থেকেই সৃষ্টি হয় চড়ক পুজোর। সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্টবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যান। পিঠে বঁড়শি গাঁথা, দড়ি দিয়ে আগুনে উপর ঝুলিয়ে দেওয়া, জিভে বা শরীরের কোনও জায়গায় লোহার শিক গেঁথে দেওয়া বা ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি কষ্ট স্বীকার তারই অঙ্গ।
৬. গাজন সূত্রপাতের দিনক্ষন নিয়ে লোককথায় শোনা যায় নানা কাহিনি। শোনা যায়, বান রাজা শিবকে তুষ্ট করতে কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্য দিয়ে তপস্যা করেছিলেন। শিবভক্তির সেই সূত্র ধরেই চড়কের সন্ন্যাসীরা আজও বান ফোঁড়ান, নানা ধরনের ঝাঁপ দেন। আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, বঁটিঝাঁপ, ঝুলঝাঁপ ইত্যাদি তারই অঙ্গ। বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে গাজনে নরমুণ্ড নিয়ে নৃত্যের প্রচলন আছে।
৭. যদিও প্রথমে গাজন উৎসব নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরবর্তীতে ১৪৮৫ সালে উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন শুরু করেন সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা। এ পূজার অপর নাম নীল পূজা। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের।
৮. ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে গাজনের নামে ‘শারিরীক নির্যাতন’ প্রথা বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
[পৌরানিক কাহিনী ভিত্তিক রচনা/ লেখক- রূপেশ সামন্ত/ ০৫.০৪.২০১৮]
No comments:
Post a Comment