শ্লেট
[প্রকাশিত- নীল আকাশের খাতা]
লেখক- রূপেশ কুমার সামন্ত
'চা এর এই গরম জলই আজ গায়ে ঢালব! একবার ঘুম থেকে উঠুক! ছেলেটা কি আমার একার
নাকি! আজ আমি আর গার্ডিয়ান মিটিংয়ে যাচ্ছি না!' স্বগতোক্তি
করতে করতে রাগে টগবগ করে ফুটছিল দিদিমনি। সকাল বেলায় গ্যাস ওভেনে চা'য়ের জন্য জলটাও ফুটছিল টগবগ করে। দিদিমনির নাম মেঘা রায়। স্বামীও শিক্ষক।
নাম সুতনু রায়। শিক্ষক দম্পতি শহরের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। তাদের একটি ছয় বছরের
ছেলেও রয়েছে। সে বিগত দু'বছর ধরে স্কুলে যাচ্ছে। সে একটি
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। গতকাল রেজাল্ট আউট হয়েছে। আজ অভিভাবক সাক্ষাতে ছাত্রদের খাতা দেখানো হবে।
রান্নাঘরের পাশের রুমে তখনও শুয়ে আছে সুতনু। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলেন, আজ আর চা খাওয়া হল না!
চুপি চুপি উঠলেন সুতনু বাবু। মনে মনে ভাবলেন,
গৃহশান্তি আগে!
প্রাপ্য ছুটির বলিদান দেওয়াই ভালো! লুকিয়ে ফোন করলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষককে।
ছুটিটা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করলেন।
সুতনু বাবু স্ত্রীকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘মেঘা, আজ আমি অম্বরের স্কুলের গার্ডিয়ান মিটিংয়ে যাবো’। দিদিমনি তো আকাশ
থেকে পড়লেন। ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকলো। রাগ এতো সহজে কমার নয়! রণমূর্তি ধারণ করে বলল,
‘আমি কি একাই ওর পড়ানোর জমিদারি নিয়ে রেখেছি। বাবার তো কোন দায়
দায়িত্ব নেই! পাশের ফ্ল্যাটের ইশিতাদির মেয়ে রিকা এবারেও
ফার্স্ট হয়েছে। তার বাবা-মা দু’জনে
মিলে পড়ায়। তাহলে আমার ছেলের রোল দশ হবে না তো কি এক হবে!’
এতক্ষণে সুতনু বুঝতে পারল দিদিমনির
রাগের কারনটা। সংসারের শান্তি রক্ষায় সুতনু চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল। রেডি হয়ে সুতনু
ছেলেকে নিয়ে স্কুলের দিকে রওয়ানা হল।
স্কুলের একটি হল ঘরের মধ্যে সভা শুরু
হল। সেখানে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক-অভিভাবিকা ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপস্থিত। প্রধান
শিক্ষিকার দীর্ঘ উপদেশ বানী কিছুক্ষণ চলল।
এরপর ডাক পড়ল রিকা রায়ের। সঙ্গে মা
ইশিতা রায়। প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ‘আপনার মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হলেও রেজাল্ট
ভালো হয়নি। অন্য সাবজেক্ট গুলোতে ফুল মার্কস পেলেও ইংলিশে পঁচিশের চব্বিশ পেয়েছে।
এক কম পেয়েছে। ওকে একটু চাপ দিন। প্র্যাকটিসটা বেশি করে করান। এতো কম পড়াশোনা করলে
হবে না’।
ইশিতা দেবী রিকার পিঠে ঠাস ঠাস করে
মারতে লাগলেন। ‘কেন এক নম্বর কম পেলি বল।
তোর আজ খাওয়াই বন্ধ’। ইশিতা দেবী রাগত ভাবে বলে চললেন।
সুতনু চুপ থাকতে পারলেন না। ইশিতা দেবীকে থামিয়ে বললেন, ‘ওকে এভাবে মারবেন না। ও তো শিশু! পরীক্ষাটাই কি
জিনিস ও তো বোঝে না! তাছাড়া এখানে ওর বন্ধুরাও রয়েছে। দেখুন,
বেচারীর কেমন লজ্জায় ভয়ে মুখটা লাল হয়ে গেছে!’
ইশিতা দেবী এবার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, 'দেখুন সুতনু বাবু,
এই সময়টাই ওকে
মানুষ করার বয়স। খেলাধুলার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে'। বৃথা বাক্যব্যয়
ভেবে সুতনু বাবু চুপ করে গেলেন।
এরপর ইশিতা দেবী ব্যাগ থেকে একটা শ্লেট
বের করলেন। সেটি প্রধান শিক্ষিকাকে দেখিয়ে বললেন,
'বাড়িতে ওকে এতো
প্র্যাক্টিস করাই যে, খাতার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তাই
শেষে একটা শ্লেট কিনলাম। দেখুন, ওকে এত প্র্যাক্টিস করিয়েছি যে শ্লেটটা কেমন
অস্পষ্ট হয়ে গেছে! আর কি করলে হবে বলুন তো?'
প্রধান শিক্ষিকা বললেন,
'বা! দারুন
আইডিয়া! ওকে শ্লেটেই আরো বেশি করে প্র্যাক্টিস করান'।
এরপর আরো কিছু অভিভাকের সঙ্গে কথা বলার পর এলো সুতনু বাবুর পালা। প্রধান
শিক্ষিকা বললেন, 'আপনার ছেলের তো পজিশন দশ হয়েছে। ওর
প্রতিটা বিষয়ে তিন চার নম্বর করে কম আছে। বাড়িতে বেশি করে প্র্যাক্টিস করান।
পড়াশোনায় একটু চাপ দিন'।
সুতনু বাবু বিনীতভাবে বললেন,
'ম্যাম, কি চাপ দিই বলুন তো! ঐটুকু ছেলের ঐ ছোট্ট দেহটা কি চাপ সইতে
পারবে? ওর মনটাও তো এখনও ততটা বড় হয় নি,
যে এতটা চাপ
নিতে পারবে!'
প্রধান শিক্ষিকা বলে উঠলেন,
'ছেলেকে মানুষ
করতে চাইলে পড়াশোনার চাপ তো দিতেই হবে'।
'হুম,
মানুষ করতেই তো
চাই। কিন্তু চাপ নেওয়ার মতো শরীর আর মনটা তৈরি হোক। সারা জীবন তো ওকে চাপ বইতে
হবে! ওকেই ওর লড়াই লড়তে হবে! এখন ওর শৈশবটা একটু উপভোগ করুক না! মন আর শরীরের
বিকাশ হয়ে গেলে দেখবেন দু'বছরের পড়া দু'মাসেই শিখে ফেলেছে। ওর শ্লেটটা এখন খালিই থাক! পরে প্র্যাক্টিসের জন্য জায়গা
তো রাখতে হবে!' গড়গড়িয়ে বলে গেলেন সুতনু বাবু।
বেগতিক বুঝে প্রধান শিক্ষিকা আর কথা বাড়ালেন না। দ্রুত সভা শেষ করে দিলেন।
সুতনু বাবু বাড়ি ফিরতে ফিরতে ছেলে অম্বরকে বলল, 'কিরে পরীক্ষায় তো ভালই রেজাল্ট করলি। যাবি নাকি
রেষ্টুরেন্টে?'
'কিন্তু মা তো রেগে আছে। রিকা ফার্স্ট
হয়েছে। আমি হতে পারিনি। মাকে আমার ভয় লাগে। আমার পড়তেই ইচ্ছে করছে না আর!' অম্বর তার বাবাকে বলল।
'দুর বোকা ছেলে! মাকে জড়িয়ে ধরে একটা হামি
খেয়ে নিবি। দেখবি মায়ের সব রাগ চলে যাবে! আর রিকা ফার্স্ট হয়েছে তো কি হয়েছে! তুই
কারো সাথে তুলনা করিস না! তুই তোর মতো করে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিস'। সুতনু ছেলেকে বলল।
'তুমি আমার খুব খুব ভালো বাবা! আমি তো
ভালো রেজাল্ট করেছি! তাহলে আমায় একটা গিফট দেবে?'
অম্বর বলল।
'কি বল?'
সুতনু বলল।
'আমায় আজ মাঠে খেলতে নিয়ে যাবে? আমার রিকার সঙ্গে খেলতে খুব ইচ্ছে করে। রিকাও খেলতে চায়। ওর
মা ওকে খেলতে দেয় না'।
চোখটা ছলছল করে উঠল সুতনুর। সে বলল,
'হ্যাঁ, তুই রোজ খেলতে যাবি। খেলবি বেশি করে, আর ইচ্ছে হলে পড়বি'। তারা
রেস্টুরেন্টে গেল। খাবারের চারটি পার্সেল নিল। অম্বর বলল, 'বাবা, আমরা তো তিনজন!
চারটে পার্সেল কি হবে?''
সুতনু বলল, 'তোর বন্ধু রিকাকে তার মা আজ খেতে দেবে না
বলেছে। ওকে একটা পার্সেল লুকিয়ে দিয়ে আসবি'। অম্বর খুব খুশি
হল। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল।
পরের বছর ক্লাস টু’য়ের রেজাল্ট বের হল। রিকা ক্লাসে থার্ড হল। আর অম্বরের
পজিশন এইট। অভিভাবক সভায় সুতনু বাবু উপস্থিত হল। সভায় রিকার মা যথারীতি রিকার পিঠে
বেশ কয়েক ঘা দিল। শাস্তিও ঘোষণা করল। রিকার দু'দিন খাওয়া বন্ধ।
সেই সঙ্গে শ্লেটটাও দেখাতে ভূললেন না! পার্থক্যটা চোখে দেখা গেল। লিখতে লিখতে
শ্লেটটা আগের চেয়ে অনেক অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
বাড়ি ফেরার পথে সুতনু বাবু ছেলেকে নিয়ে
রেস্টুরেন্টে ঢুকল। এবারে পাঁচটা পার্সেল নিল। অম্বরের কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই
সুতনু বললেন, ‘তিনটে পার্সেল আমাদের জন্য। রিকার দুদিন খাওয়া বন্ধ। ওকে দুটো
পার্সেল লুকিয়ে দিস। একটা ড্রাই ফুড আছে’। এবার অম্বর বলল, ‘আর আমার গিফট?’
সুতনু বলল, ‘আজকে তোর সঙ্গে ডাবল টাইম
খেলব। এটাই তোর
গিফট’।
‘আই লাভ ইউ বাবা!’ বলেই অম্বর বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরল। সুতনু বাবুর চোখের জল
এসে গেল।
কিন্তু মেঘা দিদিমনি ছেলেকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। ছেলের প্রতি বাবার
‘উদাসীনতা’ তাকে যেন আরও রুষ্ট করে তুলেছে। সংসারের শান্তি রক্ষায় সুতনু বাবু বড্ড
চুপচাপ হয়ে গেছেন। শুধু অদৃশ্য ভাবে রক্ষা করে চলেন ছেলে অম্বরকে।
এই ভাবেই দু’বছর কেটে গেল। ক্লাস ফোরের রেজাল্ট আউট হয়েছে। এবার রিকা
ক্লাসে টেন পজিশন পেয়েছে। আর অম্বর ক্লাসে ফার্স্ট। অভিভাবক সভায় সবাই হাজির।
প্রধান শিক্ষিকার দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে শুরু হল সভা।
সভার শুরুতেই ইশিতা দেবী উদভ্রান্তের মতো ব্যাগ থেকে শ্লেটটা বেরঙ্করতে
করতে বললেন, ‘কেন এমন হল বলতে পারেন? যে মেয়েটা ফার্স্ট হত, সে আজ পিছতে পিছতে দশ!
এরপর তো ফেল করবে! এই দেখুন শ্লেটটা। এতো প্র্যাক্টিস করিয়েছি যে, শ্লেটটা আর
স্পষ্ট দেখাও যায় না। কালো শ্লেট সাদা হয়ে
গেছে! আর কত প্র্যাক্টিস করাবো?’
সুতনু বাবু নিস্পাপ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল। মানুষ হতে গিয়ে রিকার
অবস্থাটা দেখে চোখটা ছলছল করে উঠল সুতনুর। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে উঠে শুধু বললেন,
‘শ্লেটটা তো শৈশবেই ভরিয়ে ফেলেছেন। একটুও খালি রাখেন নি! প্র্যাক্টিস করবে কোথায়?’
০৫.০৮.১৮
No comments:
Post a Comment