Popular Posts

Tuesday, 1 September 2020

রেশম পথের ইতিহাসে পাঁশকুড়া

 

রেশম পথের ইতিহাসে পাঁশকুড়া

© রূপেশ সামন্ত


     মালবেরি রেশম সবচেয়ে মূল্যবান রেশম। এই রেশম উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল পাঁশকুড়া। এই রেশম তৈরি হয় ‘বমবিকস বর্গে’র রেশমপোকার গুটি থেকে। এই পোকা মালবেরি বা তুঁত গাছের পোকা খায়। রেশমগুটি বা কোকুন দেখতে অনেকটা পায়রার ডিমের মতো। কোকুনের রঙ বিভিন্ন রকম হয়। রেশম পোকার শুককীট এক একটি কোকুন তিনদিনে তৈরি করে। শুককীট থেকে পিউপায় পরিনত হতে ৮ দিন সময় লাগে। পিউপায় পরিনত হওয়ার আগেই কোকুন গুলিকে জলে ফুটিয়ে ভিতরের পোকা মেরে ফেলতে হয়। এইরকম এক একটি কোকুন থেকেই ৫০০ মিটারেরও বেশি লম্বা সুতা সংগ্রহ করা হয়। রেশম শিল্পের চারটি পর্যায় রয়েছে- তুঁত গাছের চাষ, রেশম পোকা প্রতিপালন, রেশম সুতা পৃথকীকরণ ও বস্ত্র উৎপাদন। প্রথম দুটি পর্যায় চাষীদের দ্বারা সম্পন্ন হয় এবং শেষ দুটি পর্যায় কারখানায় সম্পন্ন হয়।


     ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর বাংলার নবাব মীরকাশিম ও ইংরেজদের মধ্যে এক সন্ধি হয়। সেই সন্ধির শর্ত অনুসারে ইংরেজ কোম্পানিকে চাকলা মেদিনীপুর, চাকলা বর্ধমান ও চাকলা ইসলামাবাদের (চট্টগ্রাম) অধিকার ছেড়ে দিতে হয়। এবিষয়ে ঐবছরের ১৫ই অক্টোবর তারিখে ইংরেজদের একটি সনন্দ প্রদান করা হয়। অধিকার পেয়েই ইংরেজরা একজন রেসিডেন্টের অধীনে মেদিনীপুর শহরে একটি কারখানা স্থাপন করে। ঘাটালের ক্ষীরপাইয়েও একটি বয়ন শিল্পের কারখানা ছিল। কারখানায় রেশমের কাঁচামাল সরবরাহের জন্য রেসিডেন্ট স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হতেন। চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ‘দাদন’ নিত এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাঁচামাল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিত। এই ব্যবসায়ীরা আবার রেশম চাষীদের সঙ্গে চুক্তি করত এবং চাষের জন্য অগ্রিম অর্থ দিত। সবচেয়ে বেশি রেশম সরবরাহ হত রাধানগর (ঘাটাল) থেকে। এছাড়াও রেশম উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল তৎকালীন কুতুবপুর, নাড়াজোল, কাশিজোড়া পরগনা (বর্তমান পাঁশকুড়া)। অর্থ্যাৎ ঘাটাল, দাসপুর, নাড়াজোল, পাঁশকুড়া জুড়ে এক বৃহৎ অঞ্চলে উন্নতমানের রেশম চাষ হত। ঘাটাল ও মেদিনীপুর কারখানার সমৃদ্ধির পথে ঘাটাল, দাসপুর, নাড়াজোল, পাঁশকুড়া, মেদিনীপুর জুড়ে এক সমৃদ্ধশালী ‘রেশমপথ’ তৈরি হয়েছিল।


     এই অঞ্চল গুলিতে যে উন্নতমানের রেশম চাষ হত, তা জানা যায় ও’মালির ‘বেঙ্গল ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার- মেদিনীপুর’ গ্রন্থ থেকে। ১৭৬৮ সালে মেদিনীপুরের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এই অঞ্চলের চাষীদের রেশমচাষে উদ্বুদ্ধ করতে অল্পমূল্যে জমি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এখানকার চাষীরা উন্নত রেশম উৎপাদন করত বলেই ব্রিটিশরা ‘দাদন’ দিয়ে অগ্রিম রেশম বুকিং করে নিত। পাঁশকুড়ার পূর্ব গোপালপুরে অধিকারীদের রয়েছে টেরাকোটার এক অনিন্দ্যসুন্দর মন্দির। এই মন্দিরটির নির্মাণ ঘিরে রয়েছে রেশম শিল্প নিয়ে এক জনশ্রুতি। মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক রাধামাধবের শিষ্য এক রেশম ব্যবসায়ীতাঁর পদবী ছিল নায়েক


সেই রেশম ব্যবসায়ীর রেশম একবার পাঁচ বছর ধরে বিক্রী হচ্ছিল না। জনশ্রুতি অনুসারে, রাধাবিনোদের কাছে মানত করার পর সব রেশম বিক্রী হয়ে যায়। সেই লাভের অর্থেই নাকি মন্দির ও রাসমঞ্চটি নির্মিত হয়েছে। রেশমের রঙ হিসাবে ব্যবহৃত হত রঙীন ‘বনকমাটি’। আর এই ‘বনকমাটি’ তৈরির অন্যতম কেন্দ্র ছিল পাঁশকুড়া। স্বাভাবিক ভাবেই তৎকালীন পাঁশকুড়া যে ‘রেশমপথে’র অগ্রনী ‘যাত্রী’ ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
[Pic Credit- Internet]

© রূপেশ সামন্ত (০১.০৯.২০)


No comments:

Post a Comment