রান্নাপূজা-
হাওড়া জেলার অনন্য লোক উৎসব
©রূপেশ সামন্ত
রান্নাপূজা কি?
রান্নাপূজা কেবল একটি সাধারণ পূজা নয়, এটি
হাওড়া জেলার আঞ্চলিক উৎসবও বটে। এটিকে অরন্ধন উৎসবও বলে। আবার এই পূজাকে কেন্দ্র
করে চলে রন্ধনও। মনসা দেবীকে উদ্দেশ্য করে পূজার অর্ঘ্য উৎসর্গীকৃত হয়। অর্থ্যাৎ
রন্ধনও অরন্ধনের মিশেলে মনসাদেবীর উদ্দেশ্যে পূজার এক অনবদ্য আয়োজন। ভাদ্রমাসে মাঠ-ঘাট-পুকুর-রাস্তা সব বর্ষার জলে ডুবে
যায়। এইসময় বিষধর সাপেরা লোকালয়ে এসে আশ্রয় নেয়। অসাবধানতায় মানুষকে ছোবলও
মারে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল মৃত্যু। তাই এইসময় মানুষ সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য
দেবী মনসাকে তুষ্ট করতে এই পূজার আয়োজন করে। এই পূজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের
মানুষরা অরন্ধন উৎসবে মেতে ওঠে। অর্থ্যাৎ রান্না না করে দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত
নৈবেদ্য, যা প্রসাদ স্বরূপ পান্তাভাত ও বাসি তরকারি খাওয়া হয়। আবার দেবীকে উৎসর্গীকৃত
নৈবেদ্যগুলো সবই আগের দিন রান্না করা। অর্থ্যাৎ রন্ধনও হয়। তাই এই সময়ের মনসা পূজাকে
‘রান্নাপূজা’ বলা হয়।
নানা নামে রান্নাপূজা
এই রান্নাপূজা বিভিন্ন নামে পরিচিত। সব রান্নাপূজার নিয়মকানুন মোটামুটি একরকম। পার্থক্য শুধু সময়ের হেরফেরে। ভাদ্র মাসের যে কোন শনিবার ও মঙ্গলবার সাধারণ ভাবে যে রান্নাপূজা হয় তাকে ইচ্ছেরান্না বলে। এতে এক একটি পরিবার তাদের ইচ্ছেমতো দিন ঠিক করে রান্না পূজো করে। ষষ্ঠীর দিন যে রান্নাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তাকে ষষ্ঠীরান্না বলে। আবার, ভাদ্র মাসের আটাশ দিনের মাথায় যে রান্নাপূজা হয়ে থাকে, তাকে আঠাশে রান্না বা গাবড়া রান্না বলে। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন রান্না আর সংক্রান্তির দিন পান্না বা রান্নাপূজা হয়। মাসের শেষ দিনে হয় বলে একে বুড়ো রান্না বলে।
প্রথা অনুসারে, সূর্য ডোবার পর থেকে রান্নার
কাজকর্ম শুরু হয়। আবার সূর্য ওঠার আগে রান্নার কাজকর্ম শেষ করতে হয়। রান্নার দিন সকাল
থেকে পূজার আয়োজন চলে। নতুন উনুন তৈরি করা হয়। বহু রকমের আনাজ, মাছ, মশালা
ইত্যাদি যোগাড় করা হয়। সূর্য ডোবার পর ভোগের হাঁড়িতে চাল ও জল দিয়ে উনুনে বসানো
হয়। গৃহিনীরা নতুন বস্ত্র পরে রান্নার কাজকর্ম করে। রান্না চলাকালীন কেউ কথা বলতে
পারে না। এরপর অন্যান্য রান্না গুলো হয়। রান্নার পদগুলি বিজোড় রাখতে হয়। নানান
মুখরোচক পদ রান্না হয়-
ভাজাভুজি- শাকভাজা, নারকেল ভাজা, ঝিঙেভাজা, চিচিঙ্গাভাজা,
ঢেঁড়সভাজা, বেগুনভাজা,
ওলভাজা, আলুভাজা, শশাভাজা, পটলভাজা, কুমড়াভাজা, কাঁচকলাভাজা, পেঁপেভাজা, উচ্ছেভাজা ইত্যাদি।
ডাল- ডালের ক্ষেত্রে খেসারির ডাল ব্যবহারের রীতি রয়েছে।
তরকারি- সারকচুর ডাঁটার তরকারি, পুঁইশাকের তরকারি, চালকুমড়োর তরকারি ইত্যাদি রান্না
করা হয়।
মাছের পদ- ইলিশ মাছের সরষে বাটা, চিংড়ির
মালাইকারি, কাটাপোনার ঝাল ইত্যাদি।
অম্বল বা টক- পাকা তেঁতুল, কুমড়ো, ঢেঁড়স, চিংড়ি মাছ বা ইলিশ সহযোগে অম্বল। অথবা চুনোমাছ দিয়েও হয়।
পায়েস- নারকেল, দুধ, চিনি ও আতপচাল দিয়ে পায়েস তৈরি হয়।
পূজা-পদ্ধতি
এরপর একটি ভোগের হাঁড়িতে জল দিয়ে পান্না
করা হয়। সূর্য উদয়ের পর একটি পরিস্কার ঘরে একটি মনসা গাছ স্থাপন করা হয়। রান্নার
ভাত তরকারি দুটি থালায় সাজিয়ে মনসা গাছের সামনে রাখা হয়। এছাড়াও চাল, কলা ও দুধের পাত্র নৈবেদ্য হিসাবে
রাখা হয়। পুরোহিত সাধারনত পূজা করে। অনেক ক্ষেত্রে রান্নাঘরে উনুনের চারিদিকে মনসা
গাছের ডাল, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ও আলপনা দেওয়া হয়।
ভোজন উৎসব
পূজার দিন বাড়িতে উনান জ্বালানো হয় না। তাই
ঐদিন রান্নার প্রশ্নই নেই। এই অরন্ধন উৎসবে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সকলকে
আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রিতরা রান্নাপূজার প্রসাদ ভক্তিভরে ও আনন্দ সহকারে খায়।
হাওড়া জেলায় মনসা দেবীকে উৎসর্গ করে বাড়ি বাড়ি রান্নাপূজা হয়। সর্পকূলের হাত থেকে
রক্ষা পেতে কলকাতার পাশের এই কলকারখানা অধ্যুসিত জেলাতে আজও রান্নাপূজা সমান
উৎসাহে অনুষ্ঠিত হয়। বিস্ময় জাগে, মেদিনীপুরের মতো জল-জঙ্গলময় সর্প অধ্যুসিত
জেলাতে এই পূজার ব্যাপকতা না থাকায়। ‘মনসামঙ্গলে’র কাব্যপটের মেদিনীপুর জেলায়
মনসাপূজার ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে তুলসী মঞ্চের পাশে মনসা গাছে পূজিতা হন দেবী
মনসা। আসলে রান্নাপূজা হাওড়া জেলার নিজস্ব লোকসংস্কৃতির অঙ্গ।
©রূপেশ সামন্ত
[কেউ কপি-পেস্ট করবেন না। শেয়ার করুন।]
No comments:
Post a Comment