Popular Posts

Saturday, 19 September 2020

গোবিন্দনগরের রাধাগোবিন্দ মন্দির বাংলার অন্যতম পুরাকীর্তির নিদর্শণ: Terracotta Temple

 

গোবিন্দনগরের রাধাগোবিন্দ মন্দির বাংলার অন্যতম পুরাকীর্তির নিদর্শণ

©রূপেশ সামন্ত


     বর্ধমানের রাজা তিলোকচাঁদের (রাজত্বকাল ১৭৪৪-১৭৭১) মৃত্যুর পর রাজা হন তাঁর ছেলে তেজচাঁদ (রাজত্বকাল ১৭৭১-১৮১৬)। তখন তেজচাঁদের বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। ফলে অভিভাবিকা রূপে রাজ্য পরিচালনা করতেন তাঁর মাতা বিষনকুমারী। রাজা তেজচাঁদের আমলেই সর্বাধিক মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। উড়িষ্যা নিবাসী জনৈক নন্দনন্দন গোস্বামী ছিলেন রাজার গুরুদেব। নন্দনন্দন গোস্বামীর পিতা ছিলে প্রাণগোবিন্দ গোস্বামী। এনারা ছিলেন রাজ অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্রাহ্মণ। রাজ আনুকুল্যে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে দাসপুর-১ ব্লকের গোবিন্দনগর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় টেরাকোটা শোভিত পঞ্চরত্ন মন্দির। এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল রাধারানি, রাধারমন ও রাধাগোবিন্দ জীউর বিগ্রহ। দেবতার নিত্যপূজা পরিচালনার জন্য রাজা ৩৬৫ বিঘা জমি সহ নন্দনন্দন গোস্বামীকে মন্দিরের সেবাইত নিযুক্ত করেন। টেরাকোটা ফলকে শোভিত পঞ্চরত্ন মন্দিরটি প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন।


     মন্দিরের সামনের দেওয়ালে রক্ষিত ফলকে লিখিত রয়েছে, ‘শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জীউ চরণ পরায়ন/ সন ১১৮৮ সাল তারিক ১৫ মাগে পুন্নিমা কাজের/ দাসপুর।। আরভ কারীকর শ্রী সফল/ রামচন্দ্র মিস্ত্রী’। অর্থ্যাৎ মন্দিরটি প্রায় ২৫০ বছর আগে বাংলা ১১৮৮ সালে এবং ইংরাজী ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মন্দিরের বিগ্রহ গুলিও প্রাচীন। মন্দিরে রয়েছে রাধারানীর অষ্টধাতুর বিগ্রহ এবং রাধারমন জীউ ও রাধাগোবিন্দ জীউর কষ্টিপাথরের বিগ্রহ।  পাঁচ পোয়া চাল ও পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে দেবতার তিনবার ভোগ হয়। এছাড়াও একবার বাল্যভোগ হয়। প্রতিদিন ৫০ জন ভোগের প্রসাদ পায়। এখানে পালিত সবচেয়ে বড় উৎসব হল ঝুলন। এছাড়াও রাস, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উৎসব উদযাপিত হয়। মন্দিরের বর্তমান প্রধান সেবাইত সতীশচন্দ্র গোস্বামী ও অজিত গোস্বামী। ©রূপেশ সামন্ত


     টেরাকোটা ফলক শোভিত অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরটি বাংলার মন্দির পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শণ। পঞ্চরত্ন রীতির পূর্বমুখী মন্দিরটি প্রদক্ষিণ-পথ সহ একটি উঁচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের সম্মুখে ত্রিখিলান প্রবেশপথ রয়েছে। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে ভোগশালাতে যাওয়ার জন্য একটি দ্বারপথ রয়েছে। মন্দিরের মাথার রত্নগুলি ওড়িয়া ধারায় রথবিন্যাস যুক্ত। বর্গাকার মন্দিরটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৩ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট।


     গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য রয়েছে একখিলান প্রবেশপথ। খিলানের উপর ভল্টের সাহায্যে গড়া গর্ভগৃহের সিলিং। মন্দিরের দক্ষিণদিকে রয়েছে একটি রাসমঞ্চ। মন্দিরের সামনের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার অজস্র ফলক। ফলকগুলি লাগানো রয়েছে মন্দিরের প্রবেশপথের চারটি স্তম্ভের গায়ে ও ত্রিখিলান প্রবেশ পথের মাথায় ৩টি আলাদা আলাদা ব্লকে। এছাড়াও মন্দিরের কার্নিশের নীচে দুটি সমান্তরাল সারিতে ছোট ছোট খোপে ও সম্মুখস্থ দুটি কোনাচ অংশের পাশে ২টি উল্লম্ব সারির ছোট ছোট খোপে টেরাকোটা ফলক গুলি লাগানো রয়েছে। ©রূপেশ সামন্ত


      মন্দিরের ত্রিখিলান প্রবেশপথের মাথায় শিবলিঙ্গ যুক্ত পীঢ়া দেউলের টেরাকোটা ফলক রয়েছে। মাঝখানের খিলানে ১৩টি, দুপাশের দুটিতে ১০টি করে এরূপ ফলক রয়েছে। এছাড়াও প্রবেশপথের মাথায় তিনটি ব্লকে ময়ূর, দশভূজা দুর্গা, রাম-রাবনের যুদ্ধ, কৃষ্ণ লীলা প্রভৃতি দৃশ্যের টেরাকোটা ফলক রয়েছে। প্রবেশপথের স্তম্ভগুলিতে রাধা-কৃষ্ণ, নৌকাবিলাস দৃশযুক্ত ফলকের আধিক্য রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে খোপ গুলিতে কপালকুণ্ডলা, রাধাকৃষ্ণ, নারী যোদ্ধা, শায়িত বিষ্ণু প্রভৃতি দৃশ্যযুক্ত টেরাকোটা ফলক রয়েছে। কিছু মিথুন দৃশ্যও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গর্ভগৃহের কাঠের দরজাটিও বেশ অলংকৃত। দরজায় অলংকৃত নকশা এবং মূর্তিগুলি উৎকৃষ্ট শিল্পরুচির পরিচয় বহন করে। ©রূপেশ সামন্ত


     এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি। মন্দিরের সেবাইতগন সূত্রে জানা যায়, এই বছরই মন্দিরটি ৩৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে সরকারীভাবে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু সংস্কারের কাজটি অত্যন্ত অদক্ষতার সঙ্গে ও অবৈজ্ঞানিক ভাবে সম্পাদন করা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। সঙরক্ষণের কাজ নিম্ন মানের হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল।




      বাসে বা ব্যক্তিগত মোটর গাড়িতে মন্দিরস্থলে যাওয়া যায়। পাঁশকুড়ার ষ্টেশন থেকে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়কে প্রায় ১৭ কিমি দূরে গৌরা বাসস্টপ। সেখানে নেমে ১.৫ কিমি পশ্চিমে এই মন্দিরটি অবস্থিত। ©রূপেশ সামন্ত

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার- সত্যরঞ্জন গোস্বামী, ক্ষেত্রসমীক্ষা- ১৫.০৯.২০]

বি.দ্রঃ কেউ কপি-পেস্ট করবেন না। শেয়ার করুন। অন্যান্য লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমার ব্লগে-

No comments:

Post a Comment