বাঙালীর দুর্গাপূজা- কৃতিত্ব কৃত্তিবাসের History of Durga Festival of Bengal
বাঙালীর দুর্গাপূজা- কৃতিত্ব কৃত্তিবাসের
©রূপেশ সামন্ত
দুর্গা পূজা বাঙালীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্বজনীন উৎসব। প্রকৃতপক্ষে
দুর্গাপূজা দু’বার হয়- আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে একবার ও চৈত্র মাসের
শুক্ল পক্ষে আরেকবার হয়। আশ্বিন মাসের দুর্গা পূজা শারদীয়া
দুর্গা পূজা ও চৈত্র মাসের দুর্গা পূজা বাসন্তী দুর্গা পূজা নামে পরিচিত।
শরৎ কালের দুর্গা পূজাই
‘অকালবোধন’----
রামায়নে রাম ও রাবণের
যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দু মতে, শরৎকালে দেবতারা
নিদ্রা দেন। তাই শরৎকালে পূজা করার বিধি নেই। কিন্তু ‘অকালে’ রামচন্দ্র এই দুর্গাকে নিদ্রা
থেকে ‘বোধন’ করে পূজা করেছিলেন বলেই এই সময়ের শারদীয়া দুর্গা
পূজাকে ‘অকালবোধন’ বলে। রাম ও রাবনের
প্রসঙ্গ মানেই ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের কথা আমরা জানি। কিন্তু বাল্মিকীর মূল রাময়ণে
দুর্গাপূজার অস্তিত্বই নেই। অকালবোধন বা দুর্গাপূজাকে বাংলায় রামায়ণ রচনাকালে
অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে যুক্ত করে গেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। ফলে যে দুর্গাপূজাকে নিয়ে বাংলা
তথা বাঙালীর এতো মাতামাতি, তার কৃতিত্ব কিন্তু কৃত্তিবাসের। সংস্কৃত ভাষায় রচিত
মূল রামায়ণে দুর্গাপূজাই নেই। তাই ভারতবর্ষের অন্যত্র দুর্গাপূজাকে নিয়ে তেমন
মাতামাতিও নেই।
মূল রামায়ণ ও
দুর্গাপূজা-----
রামায়নের রচয়িতা ছিলেন বাল্মিকী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেই মূল রামায়নে অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গা পূজার কোন উল্লেখই নেই। কিন্তু কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। ব্রহ্মাই দুর্গার পূজা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল অশুভ শক্তির বিনাশ করার জন্য রামকে সাহায্য করা। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর লেখা রামায়ণে কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এর ঘটনাকে কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন। তার লেখা রামায়ণ থেকে জানতে পারি, রাম নিজেই শরৎকালে দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। সেখানেও উদ্দেশ্য ছিল অশুভ শক্তি বা আসুরিক শক্তি রাবনের বিনাশ।
কালিকা
পুরাণ ও দুর্গা পূজা-----
কালিকা
পুরাণ অনুযায়ী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন এবং স্বর্গ রাজ্য
দখল করেছিলেন। মহিষাসুর ব্রহ্মার বরে বলিয়ান ছিলেন। এরপর অসুরকে
বিনাশ করতে বিষ্ণু, শিব,
ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারা সমবেত হয়ে তাদের তেজ থেকে দুর্গার
সৃষ্টি করলেন। সেই দুর্গাই বিনাশ করে অসুরকে। শ্রী দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদিত ‘কালিকা পুরাণ’
অনুসারে, “যে কালে অমরগন কর্তৃক মহামায়া আদ্যাশক্তি সংস্তুতা ও প্রবোধিতা হইয়া
আশ্বিণ মসের কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দশী তিথিতে ঐ দেবতাদিগের তেজো দ্বারা, স্বয়ং
প্রাদুর্ভূতা হইয়াছিলেন। সাধক তন্মাসীয় শুক্লপক্ষের সপ্তমীতে দেবী মহামায়ার
যথাবিধিমতে পূজা করিয়া অষ্টমীতে বিপুল রত্নরাজী দ্বারা পরিভূষিতা করিয়াছিলেন। সাধক
নবমী তিথিতে বিবিধ উপহারে, দেবীর বিশেষ রূপে পূজানুষ্ঠান করিলে, তৎপূজায় দশভূজা
মহামায়া পরিতুষ্টা হইয়া দেবারি মহিষাসুরের নিধন সাধন করত দশমীতে তৎ স্থান হইতে
অন্তর্হ্নিতা হইয়াছিলেন।”
বৃহদ্ধর্ম
পুরাণ ও দুর্গা পূজা-----
এই
পুরাণের মতে, রাম-রাবনের যুদ্ধে রামকে সাহায্যের জন্য কুম্ভকর্নের নিদ্রাভঙ্গ করা হল। এরপর
রাবন বধে রামচন্দ্রের মঙ্গল কামনায় সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা দুর্গার পূজা করতে চাইলেন।
কিন্তু তখন শরৎকাল, দক্ষিনায়ন। দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। অসময়ে
ব্রহ্মা দুর্গা পূজা শুরু করলেন। দুর্গা উগ্রচণ্ডী হলেন। ব্রহ্মা তাকে সন্তুষ্ট
করে ততদিনই দুর্গা পূজা করতে থাকলেন, যতদিন না রাবন বধ হয়।
এরপর দেবী দুর্গার কৃপায় নবমীতে রাবন বধ হয়। দশমীতে রামের বিজয়োৎসব। রামের
অকাল বোধনের পরই দুর্গা পূজা ব্যাপক প্রচার লাভ করে।
কৃত্তিবাসি
রামায়ণ ও দুর্গা পূজা-----
কৃত্তিবাস
ওঝা তার লেখা রামায়ণে কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর এই কাহিনি
গুলিকে অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে
অন্তর্ভূক্ত করেছেন। বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ নেই। কৃত্তিবাস
ওঝার রামায়ণ অনুসারে, রামচন্দ্রই রাবনকে বধের উদ্দেশ্যে দুর্গাপূজা
করেন। অপহৃতা পত্নী
সীতাকে উদ্ধারের জন্য বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করেছিলেন। লঙ্কার বড়
বড় বীরদের নিধন করেছিলেন। অসহায়
রাবণ তখন মাতা অম্বিকার স্তব শুরু করে দিল। রাবণের
প্রার্থণায় দেবী হৈমবতী কালীরূপে আবির্ভূত হয়ে রাবণকে নিজ কোলে তুলে নিয়ে অভয়বার্ত্তা দিলেন-
“ভয় নাই ভয় নাই রাজা দশানন।
আসিয়াছি আমি কারে কর ডর?
আপনি যুঝিব যদি আসেন শঙ্কর।
আসিতবরণা কালী কোলে দশানন”।
রাবণকে
দেওয়া দেবী কালীর অভয়বাণী সকল দেবদেবীদের মনে উৎকন্ঠার সৃষ্টি করল। এরপর ইন্দ্র
ব্রহ্মার কাছে গিয়ে রাবণকে দমন করার জন্য প্রার্থণা করলেন। সকলের প্রার্থণায়
সন্তুষ্ট হয়ে দেবাদিদেব ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে দুর্গাপূজা করার উপদেশ
দিলেন-
“রাবন-বধের জন্য বিধাতা তখন।
আর শ্রীরামেরে অনুগ্রহের কারণ।।
এই দুই কর্ম্ম ব্রহ্মা করিতে সাধন।
অকালে শরতে কৈল চণ্ডীর বোধন”।।
শ্রীরামচন্দ্র বললেন,
দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় হল বসন্তকাল, আর এখন হল শরৎকাল। শরৎকাল হল অকাল।
বিধি মতে, ‘অকালবোধনে’
নিদ্রাভঙ্গের পবিত্র সময় হলো কৃষ্ণানবমী। তা ছাড়া রাজা সুরথ
পূজা শুরু করেছিলেন প্রতিপদে।
তাহলে এখন তো পূজা সম্ভব নয়-
“শ্রীরাম আপনি কয়,
বসন্ত শুদ্ধি-সময়,
শরত অকাল এ পূজার।।
বিধি আর নিরূপণ,
নিদ্র ভাঙ্গিতে বোধন,
কৃষ্ণা নবমীর দিনে তাঁর।
সে দিন হয়েছে গত,
প্রতিপদে আছে মত,
কল্পারম্ভে সুরথ রাজার।।
সেদিন নাহিক আর,
পূজা হবে কি প্রকার,
শুক্লা ষষ্ঠী মিলিবে প্রভাতে”।
কিন্তু
ব্রহ্মা শুক্লাষষ্ঠীতে
বোধন করার জন্য বিধান দিলেন-
“বিধাতা কহেন সার,
শুন বিধি দিই তার,
কর ষষ্ঠী কল্পেতে বোধন।
ব্যাঘাত না হবে তায়,
বিধি খণ্ডি পুনরায়,
কল্প খণ্ডে সুরথ রাজন”।।
ব্রহ্মার
বিধানে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকালবোধনের প্রস্তুতি শুরু করলেন।
শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরী করে ষষ্ঠীর সন্ধায় বেল গাছের
তলায় দেবীর বোধন করলেন। অধিবাসে
শ্রীরামচন্দ্র
স্বহস্তে বাঁধলেন নবপত্রিকা। চণ্ডীপাঠ করে পূজা করলেন
। সপ্তমী ও অষ্টমীতে শ্রীরামচন্দ্র ‘বেদবিধিমতে’
পূজা করলেন। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা
করলেন। নানাবিধ বনফুল ও বনফলে ‘তন্ত্রমন্ত্রমতে’ পূজা হল-
“তন্ত্র মন্ত্রমতে পূজা করে রঘুনাথ।
একাসনে সভক্তিতে লক্ষ্মণের সাথ”।।
কিন্তু
শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার দর্শন পেলেন না। তখন বিভীষণ উপদেশ দিলেন ১০৮টি নীলপদ্মে পূজা
করার জন্য। তখন হনুমান দেবীদহ হ্রদ
থেকে এনে দিলেন একশত আটটি নীল পদ্ম। কিন্তু পূজার মুহূর্তে শ্রীরামচন্দ্র দেখতে
পেলেন একটি নীলপদ্ম কম পড়েছে। তাই তিনি তাঁর নিজের একটি
চক্ষুকেই উপড়ে দেবীকে নিবেদন করতে উদ্যত হলেন। তখন দেবী কাত্যায়নী শ্রীরামচন্দ্রকে বাধা
দিলেন। রাবণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতেই দেবী দুর্গা ছলনা করে একটি নীলপদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু
শ্রীরামচন্দ্রের অসীম ভক্তির কাছে দেবী দুর্গা বাধ্য হলেন রাবণ
বধের বর প্রদান করতে-
“রাবনে ছাড়িনু আমি,
বিনাশ করহ তুমি,
এত বলি হৈল অন্তর্দ্ধান”।
দেবী
দুর্গার বর লাভ করে শ্রীরামচন্দ্র মহাসপ্তমীতে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মহাষ্টমী ও
মহানবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণকে বধ করেন-
“বিশ্বামিত্র স্মরি বান ছাড়ি রঘুবীর।
রাবনের বুকে বিন্ধি কৈল দুই চির”।।
এরপর মহাদশমীর দিন রাবণকে দাহ করা হয়েছিল। শ্রীরামচন্দ্র মহাদশমীতেই সেই ‘অকালবোধন’ পূজা সমাপ্ত করে
দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন দিয়ে অকাল বোধন শেষ করেন। প্রকৃতপক্ষে
কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও
বৃহদ্ধর্মপুরাণের কাহিনীর কিছুটা পরিবর্তন করে তাঁর রচিত
রামায়নে অকালবোধন পর্বটি সুনিপুন ভাবে অন্তর্ভূক্ত করেন, যা বাল্মিকী রচিত মূল
রামায়ণে নেই। সেই অকালবোধন বা শরৎকালের দুর্গাপূজাই আজ বাঙালীর ঘরে ঘরে, বাংলার
কোনে কোনে মহা উৎসবে উদ্ভাসিত। কৃতিত্ব কিন্তু কৃত্তিবাসেরই।
তথ্যসূত্র-
কৃত্তিবাসী সপ্তকাণ্ড রামায়ণ
©রূপেশ সামন্ত (২২.১০.২০)
[কপি-পেস্ট করবেন না।
শেয়ার করুন।]
Comments
Post a Comment