Popular Posts

Saturday, 24 October 2020

মাছপোড়া ও লালশাকের টক দিয়ে পাঁশকুড়ার রাজপরিবারের প্রাচীন দুর্গাপূজা- Oldest Durga Puja at Panskura

মাছপোড়া ও লালশাকের টক দিয়ে পাঁশকুড়ার রাজপরিবারের প্রাচীন দুর্গাপূজা

রূপেশ সামন্ত


বর্তমান পাঁশকুড়া অতীতের কাশিজোড়া পরগনার অন্তর্গত ছিল। কাশিজোড়া রাজপরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারীরা এখন রঘুনাথবাড়ি অঞ্চলের সুন্দরনগরে বাস করেন। যতদূর জানা যায়, কাশিজোড়া রাজ পরিবারের দুর্গাপূজাই হল এই এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা। অনেক ঐতিহাসিকই এই তথ্য মানতে চান না। কিন্তু এর চেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজার উদাহরণ প্রমানিত রূপে আজ পর্যন্ত আমাদের সামনে নেই। অতীতে কাশিজোড়া পরগনার বেশির ভাগটাই ছিল জঙ্গলাকীর্ণ জলাভূমি। এইসব এলাকা ছিল মূলত দরিদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। তাদের পক্ষে রাজকীয় ব্যয়বহুল দুর্গাপূজা ছিল অলীক কল্পনা। এলাকার অন্যান্য প্রাচীন দুর্গাপূজার এযাবৎ যা ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র পাওয়া যায়, তা থেকে নিশ্চিত রূপে বলা যায় পাঁশকুড়ার সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা হল কাশিজোড়া রাজার প্রায় ২৭৫ বছরের পুরানো দুর্গাপূজা।

ইতিহাসঃ
     ১৭৪৪ সাল। কাশিজোড়া পরগনার রাজ-সিংহাসনে আরোহন করলেন রাজা নরনারায় রায়। পরগনা বিস্তারের উদ্দেশ্যে পাশের পরগনা ময়না আক্রমন করলেন। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন ময়নার রাজা কৃপানন্দের বিরুদ্ধে। ১৭৪৪ সালের সেই যুদ্ধে ময়নার রাজাকে পরাজিত করে ময়নার ১৭টি মৌজা দখল করে নেন। জনশ্রুতি অনুসারে, শরৎকালীন যুদ্ধ জয়ের গৌরবে সেই বছর থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন করলেন। তখন রাজধানী ছিল হরশংকর গড়ে। ১৭৪৪ সালে হরশংকর গড়েই রাজা নরনারায়ণ রায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। প্রজারা সেই দুর্গাপূজায় অংশগ্রহন করতেন। রাজা নরনারায়ণ রায় রাজত্ব করেন ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত। এরপর কাশিজোড়া পরগনার রাজা হয়েছিলেন রাজা রাজনারায়ণ রায় (১৭৫৬-১৭৭০)। রাজা সুন্দরনারায়ণ রায়ের আমলে (১৭৭০-১৮০৬) রাজধানী হরশংকর গড় থেকে বর্তমান সুন্দরনগরে স্থানান্তরিত হয়। রাজপরিবারের দুর্গাপূজাও স্থানান্তরিত হয়। সেই থেকে সুন্দরনগরে রাজপরিবারে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। রাজপরিবারের দুর্গাপূজা এইবছর ২৭৬তম বর্ষে পদার্পণ করল।


বর্ধমান রাজার ভেটঃ
     কাশিজোড়া রাজপরিবারের সঙ্গে বর্ধমান রাজপরিরের সুসম্পর্ক ছিল। প্রতিবছর দুর্গাপূজায় বর্ধমান রাজপরিবার থেকে ভেট বা উপহার সামগ্রী আসতো। হাঁটা পথে সেইসব উপহার সামগ্রী আসত চার/পাঁচদিন ধরে। আজ থেকে সত্তর বছর আগে পর্যন্ত এই প্রথা বহাল ছিল।

অস্ত্রপূজা ও কৃষ্ণরায়ের পূজাঃ
     দুর্গাপূজার দালানেই একই সঙ্গে পূজা করা হয় রাজাদের ব্যবহৃত বড় বড় তলোয়ার। বর্তমানে তিনটি বড় তলোয়ার রয়েছে। এছাড়াও রাজপরিবারে প্রতিবছর দুর্গাপূজা শুরুর আগে পারিবারিক দেবতা কৃষ্ণরায়ের পূজার প্রথাও চলে আসছে।

লোককথাঃ
    রাজপরিবার সূত্রে জানা যায় পারিবারিক ভাবে প্রবহমান অনেক লোককথা। রাজা নরনারায়ণ রায় যুদ্ধযাত্রা কালের প্রাক্কালে নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ছিলেন। দেবী দুর্গা রাজাকে যুদ্ধ জয়ের বর প্রদান করেছিলেন এবং যুদ্ধ জয়ের পর দেবী পূজা করতে বলেছিলেন। রাজা সেই রাজকীয় ব্যয়বহুল পূজার অপারগতার কথা জানালে, দেবী দুর্গা কেবল মাছপোড়া ও লালশাকের টক দিয়ে পূজা করতে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন। সেই থেকে আজও পূজার বহু-ব্যঞ্জনে  আবশ্যিক ভাবে মাছপোড়া ও লালশাকের টক থাকে।
     রাজ পরিবারের পূজার প্রথা অনুযায়ী, বহু-ব্যঞ্জন রান্নায় পুরুষ বা বিবাহিত নারীর অংশগ্রহন করার অধীকার নেই। কেবল মাত্র রাজপরিবারের অবিবাহিত নারীরাই বহু-ব্যঞ্জন রান্নার কাজ করেন।



শেষকথাঃ
     ঘুরে আসতে পারেন পাঁশকুড়ার সবচেয়ে পুরানো দুর্গাপূজা। সেই দুর্গাপূজা আজও বয়ে চলেছে অনেক ইতিহাস বুকে নিয়ে। পাঁশকুড়া ষ্টেশনের দক্ষিণে তমলুক-পাঁশকুড়া বাসরুটে ৬কিলোমিটার দূরে জোড়াপুকুর বাসস্ট্যাণ্ড। ঐ বাসস্ট্যাণ্ড থেকে উত্তরে ১কিমি এগোলেই পড়বে রাজপরিবারের বাড়ি ও দুর্গাপূজা।
লেখক- রূপেশ সামন্ত

No comments:

Post a Comment