Popular Posts

Sunday, 17 November 2024

ফিরিয়ে দাও সেই বেহুলা

👉ফিরিয়ে দাও সেই বেহুলা নদী
©রূপেশ সামন্ত
পাঁশকুড়াকে গ্রাস করতে চাইছে কংসাবতী। মানুষ না মানলেও ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে প্রকৃতির পুনরাবৃত্তির বৈজ্ঞানিক নিয়মেই পাঁশকুড়াকে একদিন গ্রাস করে নেবে কংসাবতী, এ কথা সত্য।
২০১৩ সালে এবং ২০২৪ সালে গড় পুরুষোত্তমপুর ও জন্দরায় ভাঙনের মাধ্যমে কংসাবতী তার প্রাচীন পথ ও রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও রানিহাটী, চাঁপাডালি, কল্লা, ভবানিপুর, তিলন্দপুর প্রভৃতি স্থানের ভাঙন প্রবনতা প্রবল ভাবে বাড়ছে। আগামী দিনে আরও বাড়বে। কিন্তু কেন এই প্রবনতা?
আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। মহিষাদলের রাজ সিংহাসনে তখন রাজা কল্যান রায়। তিনি সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কাশিজোড়া পরগনার (এর মধ্যে ছিল আধুনিক পাঁশকুড়াও) সিংহাসনে আসীন ছিলেন রাজা প্রতাপনারায়ণ রায় (রাজত্বকাল ১৬২৪-১৬৬০)। মহিষাদলের রাজা কল্যান রায় কংসাবতী নদীর চাঁপাডালির কাছ থেকে খাল কেটে দক্ষিণ দিকে নিয়ে গিয়ে ফেললেন হলদি নদীতে। মালীবুড়োর 'লস্কর দিঘির মালা' গ্রন্থে সেই দৃশ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই খালটি রায়খালি বা নয়া কাটান নামে পরিচিত ছিল। উল্লেখ্য, কংসাবতী নদীর বর্তমান প্রবাহপথ, যা চাঁপাডালির পর থেকে দক্ষিণ দিকে রয়েছে, তা আজ থেকে ৩৫০ বছর আগে ছিল না। তখন কংসাবতী নদী চাঁপাডালি থেকে পূর্ব দিকে প্রতাপপুর, চাঁচিয়াড়া, আটবেড়িয়া, রঘুনাথবাড়ি, হরশংকর, টুল্যা, রাধামনির উপর দিয়ে গিয়ে বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে তমলুকে রূপনারায়ণে পড়ত। এই নদীখাতটি বর্তমানে অবলুপ্ত। পুরানো মানচিত্রে এই নদীখাত 'ওল্ড বেড অফ কসাই' নামে উল্লিখিত। বর্তমানের উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণে এই মজা নদীখাতের অস্তিত্ব স্পষ্ট ভাবেই জানা যায়। এই নদীটিই এককালে বেহুলা, গৌরি, গাঁঙুড়া ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। 
     মহিষাদলের রাজা খাল কেটে কংসাবতীর জল মহিষাদলে নিয়ে গিয়ে নিজের রাজ্যের জল-সমস্যা মেটালেও অন্য এক গভীর সংকট তৈরি করলেন। ভূ-প্রকৃতি গত ভাবে এতদঞ্চলের দক্ষিনাংশ ঢালু। ফলে কংসাবতীর বেশির ভাগ জল খাল দিয়েই প্রবাহিত হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে খালটিই কংসাবতীর মূল প্রবাহ হয়ে গেল। আগের প্রবাহপ্রথটি মজা নদীতে পরিনত হতে থাকল। ধীরে ধীরে তা বেহুলা নদী নামে ক্ষীণধারায় প্রবাহিত হতে লাগল। LSS O'Malley সাহেব তাঁর ১৯১১ সালের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে ১০০ বছর আগেও বেহুলা বা গৌরি নদীর প্রবহমানতার কথা উল্লেখ করে গেছেন। অর্থাৎ ১৮১১ সালেও এই নদী ক্ষীণ হলেও প্রবহমান ছিল। ১৮৫২ সালে ব্রিটিশরা চাঁপাডালিতে বেহুলার মুখ স্থায়ী ভাবে বেঁধে দিল। এইভাবে সমাধিস্থ হল প্রকৃতির প্রবাহ পথের। 
    কংসাবতীর নিম্ন-প্রবাহপথের এই পরিবর্তনই হল প্রকৃতির উপর মানুষের হস্তক্ষেপের জ্বলন্ত উদাহরণ। খাল কেটে ও গতিপথে বাঁধ দিয়ে মানুষের হস্তক্ষেপে একটি নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার মোহনাও পরিবর্তন হয়ে গেছে রূপনারায়ণ থেকে হলদি নদীতে।
     প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ প্রকৃতি কখনো মানবে না। সে বারবার জানানও দিচ্ছে। ভূ-প্রকৃতির নিয়মেই কংসাবতীর নিম্ন উপত্যকা ক্রমশ উঁচু হচ্ছে। কংসাবতী ফিরে পেতে চাইছে তার আদিপথ- বেহুলা নদীর পথে। কংসাবতীর প্রাচীন সেই বেহুলা নদীর পথে আজ গড়ে উঠেছে কংক্রিটের নির্মান। নদীখাতকে গ্রাস করেছে মানুষ। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, কংসাবতী গ্রাস করবে তার প্রাকৃতিক পথকে প্রাকৃতিক নিয়মেই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সূত্র মেনেই বেহুলা নদীর খাত ধরে পাঁশকুড়াকে একদিন গ্রাস করে নেবে কংসাবতী। প্রকৃতির রুদ্র রূপের কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। তার ধ্বংসলীলার কাছে মানুষ খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে একদিন। কংসাবতী ফিরিয়ে নেবে তার আদি প্রাকৃতিক পথ। সময় থাকতেই ফিরিয়ে দাও সেই বেহুলা নদী। 
©রূপেশ সামন্ত


No comments:

Post a Comment