বন্ধু বন্ধু খেলা — ট্রাম্পের কূটনৈতিক ছলনা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রচার অনেকবারই মিডিয়ার শিরোনামে এসেছে। ‘Howdy Modi’ হোক কিংবা ‘Namaste Trump’ — এই দুই রাষ্ট্রনেতার পারস্পরিক বন্ধুত্বের বন্দনা যেন এক নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি আর কূটনৈতিক মঞ্চে ট্রাম্পের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি জটিল ও কূটকৌশলী — প্রকারান্তরে বলা চলে, ছলনাময়।
কাশ্মীর উপত্যকার পহেলগামে ভারতীয় নিরীহ মানুষের ওপর ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এক উত্তাল যুদ্ধসঙ্কটের দিকে গড়ায়। পাকিস্তানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। এই সময়ে ট্রাম্প মুখে ভারতের পাশে থাকার কথা বললেও, তাঁর অবস্থান ছিল একদম “ভারসাম্যপূর্ণ” — অর্থাৎ, পাকিস্তানের পক্ষেও দরজা খোলা রেখে কূটনৈতিক খেলায় মাতেন।
তিনি সরাসরি পাকিস্তানকে অভিযুক্ত না করে বরং “উভয়পক্ষের সংযম” কামনা করেন এবং “মধ্যস্থতার” প্রস্তাব দেন। এই ‘মধ্যস্থতা’ আদতে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক চাপে পুরোপুরি একঘরে হওয়া থেকে বাঁচায়। এটা ছিল আমেরিকার সেই পুরনো দ্বিচারিতা — যেখানে বন্ধুর মুখে হাসি, পেছনে বাণিজ্য ও সামরিক স্বার্থের হিসাব।
কেন এমন ছলনা?
আমেরিকার প্রাথমিক লক্ষ্য নিজস্ব সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বজায় রাখা। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকার কৌশলগত মিত্র, বিশেষত আফগানিস্তান ভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ ও চিনের সাথে দ্বন্দ্বের পেছনে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ অবহেলা করেনি। আবার ভারত ছিল এক বিশাল বাজার — অস্ত্র, প্রযুক্তি, এবং ব্যবসার। এছাড়াও চিনকে রোখার প্রশ্নে ভারতের সাহায্য দরকার আছে। এই দ্বৈত স্বার্থ বজায় রাখতেই ট্রাম্প খেলেছেন “বন্ধু বন্ধু খেলা"। আমেরিকা সত্যিই যদি জঙ্গি নির্মূল করতে চাইত, তাহলে জঙ্গিদের আঁতুড়ঘর পাকিস্তানকে এই যাত্রায় উচিৎ শিক্ষা দিতে ভারতের পাশে 'বন্ধু' হিসাবে কার্যকরী রূপে দাঁড়াত। তা না করে নিজেদের স্বার্থে বন্ধু বন্ধু খেলা চালিয়ে পরোক্ষে জঙ্গিদের হাতকেই শক্ত করলেন ট্রাম্প। এই খেলায় আরও একটি লাভ আছে ট্রাম্পের। যতদিন এই উপমহাদেশে জঙ্গি প্ররোচনায় ভারত-পাক দ্বৈরথ থাকবে, ততদিন দুই দেশই আমেরিকাকে 'বড়দাদা' মানবে, আর অস্ত্র বেচাকেনাটাও মন্দ হবে না।
ভারতের জন্য শিক্ষণীয় কী?
ভারতের উচিত ট্রাম্প বা যেকোনো মার্কিন প্রশাসনের উপর অন্ধ বিশ্বাস না করে কূটনৈতিক দূরদর্শিতা বজায় রাখা। আত্মনির্ভর সামরিক শক্তি গড়ে তোলা এবং আরও বিশ্বস্ত মিত্র গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান বা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীরতর করা উচিত। শুধু আমেরিকার উপর নির্ভর করলে ভবিষ্যতে কূটনৈতিক ব্যালেন্স নষ্ট হতে পারে।
ট্রাম্পের “বন্ধু” হওয়া মানে তাঁর শর্তে চলা। “America First” ছিল তাঁর মূলনীতি — এবং সেই নীতির আলোকে তিনি কখনও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আলিঙ্গন করেছেন, কখনও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অঢেল সামরিক সাহায্য দিয়েছেন। তাঁর কূটনৈতিক চাল ‘বন্ধুত্ব’ নয়, বরং ছিল এক চতুর ব্যবসায়ী হিসেব। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্ভাবনার সময় তাঁর ভূমিকা নিঃসন্দেহে আমেরিকার দ্বিচারিতার আরেকটি দৃষ্টান্ত।
সুতরাং, বন্ধুত্বের মোহজাল নয়, ভারতের উচিত নিজের শক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর আস্থা রাখা — কারণ বৈশ্বিক রাজনীতি চিরকালই স্বার্থের খেলা, আর ট্রাম্প তার সবচেয়ে নাটকীয় রূপ।
---
© রূপেশ সামন্ত
No comments:
Post a Comment