----- বজ্রপাতের বিপদ থেকে বাঁচুন-----
রূপেশ সামন্ত/ ১৫.০৬.২০১৮
‘অনুশীলনের সময় বাজ পড়ে মৃত্যু হল তরুন ক্রিকেটারে। মৃতের নাম দেবব্রত পাল (২১)। রবিবার দুপুর (১১ই জুন, ’১৮) ২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিন কোলকাতার বিবেকানন্দ পার্কে।’ (আ.বা.প) খবরটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। কিন্তু এই ব্জ্রপাত নিয়ে নানান কুসংস্কার ও ভূল ধারনা রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান কি বলে?
---বজ্রপাত কিভাবে হয়---
উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়াতেই বজ্রপাত বেশি হয়।
উত্তপ্ত বায়ু দ্রুত গতিতে উপরে ওঠার সময় দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হয়।
এই সময় বাতাসের জলীয়বাষ্প বৃষ্টিকণা, শিশিরবিন্দু ও তুষারকণায় পরিণত হয়।
বৃষ্টিকণা ও তুষারকণার পারস্পরিক সংঘর্ষ হয়। যার ফলে উপরের
দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প পরমাণু বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন
হারায় তা পজিটিভ চার্জে এবং যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে তা নেগেটিভ চার্জে
চার্জিত হয়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা পজিটিভ চার্জ থাকে মেঘের উপর পৃষ্ঠে এবং ভারী
নেগেটিভ চার্জ থাকে নিচের পৃষ্ঠে। যথেষ্ট পরিমাণ পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জ জমা হওয়ার
পর পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণের দরুণ তড়িৎ মোক্ষণ (electrostatic discharge) প্রক্রিয়া শুরু
হয়। এই তড়িৎ মোক্ষণের সময় পজিটিভ থেকে নেগেটিভ চার্জের দিকে ঝলকানি আকারে বিদ্যুৎ
বা স্পার্ক প্রবাহিত হয়। ঐ বিদ্যুৎ মোক্ষণ আকাশে না থেকে মাটিতে এলে বজ্রপাত বলি। বাতাসের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত বজ্রবিদ্যুৎ প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উৎপন্ন করে।
ফলে বায়ুর দ্রুত প্রসারণ হয় ও তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়।
---বজ্রপাতের প্রকারভেদ---
(ক) আন্তঃমেঘ সংঘাত- মেঘের নিজস্ব পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের মধ্যে (খ) মেঘ ও মেঘের সংঘাত- একটি মেঘের পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ চার্জের সাথে অন্য মেঘের নেগেটিভ কিংবা পজিটিভ চার্জের মধ্যে (গ) ভূমি মোক্ষণ- মেঘের পজিটিভ চার্জের সাথে ভূমির নেগেটিভ চার্জের মধ্যে।
-----বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ চমকায় কেন?-----
বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী। তা সত্বেও
বজ্রপাতের সময় বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। আসলে মেঘে জমা হওয়া স্থির বিদ্যুৎ এত উচ্চ বিভব
শক্তি (১০ মিলিয়ন ভোল্ট
পর্যন্ত) উৎপন্ন করে যে, তা বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার জন্য বাতাসের
একটা সরু চ্যানেলকে আয়নিত করে পরিবাহী পথ তৈরি করে। আয়নিত পরমাণু থেকে বিকীর্ণ
শক্তি তীব্র আলোর ঝলকানি তৈরী করে।
-----বজ্রপাতের সময় শব্দ উৎপন্ন হয় কেন?-----
বজ্রপাতের সময় বাতাসের যে সরু চ্যানেলের
মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তার তাপমাত্রা প্রায় ৩০০০০ ডিগ্রি সেঃ এ উন্নীত হয়
এবং বাতাসের চাপ স্বাভাবিক চাপ থেকে প্রায় ১০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই চাপ এবং
তাপমাত্রায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার ভাগের এক ভাগ। এত কম
সময়ে তাপমাত্রা ও চাপের এত ব্যাপক পরিবর্তন হয় যে, চারপাশের বায়ুন্ডলকে প্রচণ্ড গতিতে
সম্প্রসারিত করে। তার ফলেই বজ্রপাতের সময় তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়।
-----বজ্রপাতের সময় কি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়?-----
বজ্রপাত গড়ে এক বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন
জুল শক্তি উৎপন্ন করে। যে পরিবার গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ১০০- ১৫০ ইউনিট
বিদ্যুৎ ব্যাবহার করে,
সেই পরিবার একটি
বজ্রপাতের বিদ্যুৎ শক্তি জমা করতে পারলে প্রায় ১৫ বছর বিনা
পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যাবহার করতে পারবেন। তবে সে ক্ষেত্রে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ ধরতে এক
সেকেন্ডেরও কম সময় পাওয়া যাবে। কারণ বজ্রপাতের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে এক সেকেন্ডেরও
কম সময়ের মধ্যে।
---কিভাবে বাঁচবেন---
১. বজ্রপাতের সময়টুকু ঘরে অবস্থান করুন।
২. ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাহির হবেন না।
৩. খুব প্রয়োজনে রবারের জুতা পড়ে বাইরে বের হতে পারেন।
৪. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উচু স্থানে থাকবেন না।
৫. বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে যতটা সম্ভব মাথা নিচু করে বসে থাকুন।
৬. বাইরে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
৭. উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব খুটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদির নিচে থাকবেন না।
৮. কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকুন।
৯. বজ্রপাতের সময় গাড়ীর ভেতর থাকলে, গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না, সম্ভব হলে গাড়ীটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। এই সময়
মোটর সাইকেল বা সাইকেল চালাবেন না।
১০. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকবেন না। জানালা দরজা বন্ধ রাখুন।
১১. বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজসহ সকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বন্ধ রাখুন।
১২. বজ্রপাতের সময় প্লাষ্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন।
১৩. বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন।
১৪. বজ্রপাতের সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে থাকুন।
১৫. বজ্রপাতের
সময় সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি ম্পর্শ করবেন না।
১৬. প্রতিটি বিল্ডিং এ বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন।
১৭. বজ্রপাতের
সময় বাড়িতে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে থাকুন।
বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মত করেই চিকিৎসা করতে হবে।
১৮.
বজ্রাহত
ব্যক্তিকে খালি হাতে স্পর্শ করবেন না।
রূপেশ সামন্ত/ ১৫.০৬.২০১৮
No comments:
Post a Comment