সতীর
‘পাশুলি’ অলংকার থেকেই ডেবরার দ্বারবাসুলী শক্তিপীঠের আবির্ভাব
©রূপেশ সামন্ত
‘লক্ষ টাকার ধন মায়ের চরণের
(পা) শুলি (পাশুলি)’।
পরাণ বল্লভের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ থেকে জানা যায়, সতী মায়ের পায়ের আঙ্গুলের বহু মূল্যবান আংটি (পাশুলি) পতিত হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরা থানার দ্বারি গ্রামে। সেই থেকেই এই স্থানে ‘পাশুলি’ দেবীর অধিষ্ঠান। সৃষ্টি হয় দ্বারবাশুলি শক্তিপীঠ। সতী দেবী দক্ষ রাজার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশে দক্ষরাজা একটি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে দক্ষরাজা মহাদেব শিবকে অপমান করেছিলেন। দেবী সতী স্বামীর সেই অপমান সহ্য করতে পারেননি। দেবী সেই যজ্ঞের আগুনে নিজেকেই আহুতি দেন। যজ্ঞের আগুনে আত্মঘাতী হন সতী। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন মহাদেব। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভয়ে ভগবান বিষ্ণু প্রলয় থামাতে সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন। সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। স্থানীয় লোককথা অনুসারে, সেই সময় নাকি দেবীর ছিন্নভিন্ন দেহ থেকে পায়ের আঙ্গুলের অঙ্গুরীবিশেষ বা ‘পাশুলি’ অলংকার এই দ্বারি গ্রামে পতিত হয়েছিল। ‘পাশুলি’ শব্দটি উচ্চারণগত বিবর্তণের মধ্য দিয়ে ‘বাশুলি’ দেবী নামে পরিচিতি লাভ করেছে। দ্বারি গ্রামে অধিষ্ঠিত হওয়ায় এই দেবী ‘দ্বারবাশুলি’ নামেও পরিচিত।
কথিত আছে, পরাণ
বল্লভ নামে এক রাখাল শক্তিপীঠ সংলগ্ন পুকুরে স্নান করতে নেমে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই রাখাল
নাকি তিনদিন পর পুকুর থেকে উঠে এসেছিল। তখন তাঁর হাতে ছিল চামর। সেই পরাণ বল্লভের মুখ-নিঃসৃত
বানী থেকে রচিত হয়েছিল দ্বারবাশুলির সৃষ্টি বৃত্তান্তের কাব্য- ‘চণ্ডীমঙ্গল’। সেই ‘চণ্ডীমঙ্গল’
পালাগান আজও গাওয়া হয় দেবীর মণ্ডপে। বর্তমানে পালাগান সম্পাদন
করে স্থানীয় পিতাড়ী পরিবার। এই পিতাড়ী পরিবারের সঙ্গে পরাণ বল্লভের সম্পর্কটিও জানা
যায়। অবিবাহিত পরাণ বল্লভ ‘চণ্ডীমঙ্গল’ পালাগানের দায়িত্ব তৎকালীন সময়ে পিতাড়ী
পরিবারের হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরাণ বল্লভের সেই কিংবদন্তীর চামরটি এখনও সংরক্ষিত
রয়েছে।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, বাশুলি দেবীর সঙ্গে জড়িয়ে
রয়েছে রাজ মহিমা। ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কাশিজোড়া পরগনার রাজা রাজনারায়ণ রায় (রাজত্বকাল
১৭৫৬-১৭৭০) পার্শবর্তী সাহাপুর পরগনা (কেদারকুণ্ডু) আক্রমন করেন। দ্বারবাশুলী
শক্তিপীঠের অবস্থান ছিল সাহাপুর পরগনায়। যুদ্ধে সাহাপুর পরগনার জমিদার মুকুটনারায়ণ
রায়ের বিরুদ্ধে জয়লাভ করায় রাজা রাজনারায়ণ রায় বাশুলি দেবীর মন্দিরে ৩৬০ বিঘা জমি
দান করেন। এছাড়াও রাজা রাঢ়দেশ থেকে ব্রাহ্মণ আনয়ণ করে প্রত্যেককে জমিদান করে
পরগনায় বসতি দান করেছিলেন।
দেবীর নিত্যপূজা হয়। বহু দূর-দূরান্ত থেকে
ভক্তবৃন্দ মনস্কামনা পূরণে হাজির হন। ভোগরান্নাও হয়। তবে কাশিজোড়া রাজার
পৃষ্ঠপোষকতায় দেবী যে রাজমহিমা প্রাপ্ত হয়েছিল, বর্তমানে গরীব সেবাইতের কাঁধে ভর
করে সেই রাজকীয়তা উধাও। তবে ভক্তি-নিষ্ঠার ‘রাজকীয়তা’র এতটুকুও ঘাটতি নেই। প্রধান
সেবাইত হলেন অর্ধেন্দু চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, বাসুলী দেবী হলেন চণ্ডীর রূপ। এই
দেবীকে দুর্গাজ্ঞানে পূজা করা হয়। মন্দিরে পর্দার আড়ালে দেবী অধিষ্ঠিত রয়েছেন ‘পঞ্চমুণ্ডি’
আসনে। একমাত্র দূর্গা পূজার সময় ষষ্ঠীর দিন দেবীর অঙ্গরাগের সময় তাঁর দর্শণ পাওয়া
যায়। সন্ধিপূজার দিন বলি হয়। মন্দিরে বাশুলি দেবী ছাড়াও জয়দূর্গা ও দক্ষিণাকালির
মূর্তি রয়েছে।
ডেবরা থানার ৬নং জাতীয় সড়কের আষাড়ীবাঁধ
বাসস্টপ থেকে ৪ কিমি দক্ষিণে এগোলে মন্দির স্থলে পৌঁছানো যায়। চার চাকার ছোট
গাড়িতে যাতায়াত যোগ্য।
©রূপেশ সামন্ত
[কপি-পেস্ট করবেন না।
শেয়ার করুন]
No comments:
Post a Comment