পাঁশকুড়া পৌরসভা জুড়ে কংসাবতীর ভাঙন প্রবনতা উত্তরোত্তর বাড়বে

পাঁশকুড়া পৌরসভা জুড়ে কংসাবতীর ভাঙন প্রবনতা উত্তরোত্তর বাড়বে- ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য
©রূপেশ সামন্ত
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেকার কথা। মহিষাদলের রাজ সিংহাসনে তখন রাজা কল্যান রায়। তিনি সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কাশিজোড়া পরগনার (আধুনিক পাঁশকুড়া) সিংহাসনে আসীন ছিলেন রাজা প্রতাপনারায়ণ রায় (রাজত্বকাল ১৬২৪-১৬৬০)। মহিষাদলের রাজা কল্যান রায় ঘাঁটি গাড়লেন প্রতাপপুর-২ অঞ্চলের বর্তমান রায়বাঁধে। শয়ে শয়ে মানুষ শুরু করল খাল কাটতে। কংসাবতী নদীর চাঁপাডালির কাছ থেকে সেই খাল কেটে দক্ষিণ দিকে নিয়ে গিয়ে ফেলা হল হলদি নদীতে। মালীবুড়োর 'লস্কর দিঘির মালা' গ্রন্থে সেই দৃশ্যের সুন্দর বর্ণনা পাই। সেই খালটি রায়খালি বা নয়া কাটান নামে পরিচিত ছিল। উল্লেখ্য, কংসাবতী নদীর বর্তমান প্রবাহপথ, যা চাঁপাডালির পর থেকে দক্ষিণ দিকে রয়েছে, তা আজ থেকে ৩৫০ বছর আগে ছিল না। তখন কংসাবতী নদী চাঁপাডালি থেকে পূর্ব দিকে প্রতাপপুর, চাঁচিয়াড়া, আটবেড়িয়া, রঘুনাথবাড়ি, হরশংকর, টুল্যা, রাধামনির উপর দিয়ে গিয়ে বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে তমলুকে রূপনারায়ণে পড়ত। এই নদীখাতটি বর্তমানে অবলুপ্ত। পুরানো মানচিত্রে এই নদীখাত 'ওল্ড বেড অফ কসাই' নামে উল্লিখিত। বর্তমানের উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণে এই মজা নদীখাতের অস্তিত্ব স্পষ্ট ভাবেই জানা যায়। এই নদীটিই এককালে বেহুলা, গৌরি, গাঁঙুড়া ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। ©রূপেশ সামন্ত।
     মহিষাদলের রাজা খাল কেটে কংসাবতীর জল মহিষাদলে নিয়ে গিয়ে নিজের রাজ্যের জল-সমস্যা মেটালেও অন্য এক গভীর সংকট তৈরি করলেন। ভূ-প্রকৃতি গত ভাবে এতদঞ্চলের দক্ষিনাংশ ঢালু। ফলে কংসাবতীর বেশির ভাগ জল খাল দিয়েই প্রবাহিত হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে খালটিই কংসাবতীর মূল প্রবাহ হয়ে গেল। আগের প্রবাহপ্রথটি মজা নদীতে পরিনত হতে থাকল। ধীরে ধীরে সে বেহুলা নামে ক্ষীণধারায় পরিনত হল। LSS O'Malley সাহেব তাঁর ১৯১১ সালের ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে ১০০ বছর আগেও বেহুলা বা গৌরি নদীর প্রবহমানতার কথা উল্লেখ করে গেছেন। অর্থাৎ ১৮১১ সালেও এই নদী ক্ষীণ হলেও প্রবহমান ছিল। ১৮৫২ সালে ব্রিটিশরা চাঁপাডালিতে বেহুলার মুখ স্থায়ী ভাবে বেঁধে দিল। এইভাবে সমাধিস্থ হল প্রকৃতির প্রবাহ পথের। 
    কংসাবতীর নিম্ন-প্রবাহপথের এই পরিবর্তনই হল প্রকৃতির উপর মানুষের হস্তক্ষেপের জ্বলন্ত উদাহরণ। খাল কেটে ও গতিপথে বাঁধ দিয়ে মানুষের হস্তক্ষেপে একটি নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে শুধু তাই নয়, তার মোহনাও পরিবর্তন হয়ে গেছে রূপনারায়ণ থেকে হলদি নদীতে। ©রূপেশ সামন্ত।
     প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ প্রকৃতি কখনো মানবে না। সে বারবার জানানও দিচ্ছে। ভূ-প্রকৃতির নিয়মেই কংসাবতীর নিম্ন উপত্যকা ক্রমশ উঁচু হচ্ছে। কংসাবতী ফিরে পেতে চাইছে তার আদিপথ- বেহুলা নদীর পথে। বেহুলার উৎসমুখের এলাকা ডোমঘাঠ, রাণিহাটি, গড় পুরুষোত্তমপুর, চাঁপাডালি, জন্দরা, কল্লা, ভবানিপুর, তিলন্দপুর প্রভৃতি স্থানের ভাঙন প্রবনতা তাই বাড়ছে। অর্থাৎ পাঁশকুড়া পৌরসভার দক্ষিণ সীমানা বরাবর কংসাবতী নদীর বামতীর ভাঙনপ্রবন। আগামী দিনে এই প্রবনতা আরও বাড়বে। ২০১৩ সালে গড় পুরুষোত্তমপুরে ভাঙনের মাধ্যমে কংসাবতী তার প্রাচীন পথ ও রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। কংসাবতীর প্রাচীন পথে আজ গড়ে উঠেছে কংক্রিটের নির্মান। নদীখাতকে গ্রাস করেছে মানুষ। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, কংসাবতী গ্রাস করবে তার প্রাকৃতিক পথকে প্রাকৃতিক নিয়মেই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সূত্র মেনেই বেহুলা নদীর খাত ধরে পাঁশকুড়া ও তমলুকের একাংশকে একদিন গ্রাস করে নেবে কংসাবতী। সেদিন হয়তো মোহনার কাছের এই ভয়াল-ভয়ংকর কংসাবতী তথা প্রাচীন কপিশা নদীকে দেখবো। প্রকৃতির রুদ্র রূপের কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। তার ধ্বংসলীলার কাছে মানুষ খড়-কুটোর মতো ভেসে যাবে একদিন। কংসাবতী ফিরিয়ে নেবে তার আদি প্রাকৃতিক পথ। ©রূপেশ সামন্ত
(এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশ, আরও বিস্তৃত বিশ্লেষণ, তথ্যসূত্র ও ছবি পাবেন আমার আগামী প্রকাশনায়। খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে। দয়াকরে কেউ কপি-পেস্ট করবেন না। ভালো লাগলে শেয়ার করুন।)
©রূপেশ সামন্ত।

Comments

  1. টুল্যা,রঘুনাথবাড়ির আশেপাশের গ্রামে আমরা ছোটো থেকে বালি মাটি দেখে আসছি। কিছু কিছু পুকুরে মাটি পাওয়া যায় না, শুধুই বালি। ওই রকম বালি মাটি দেখে মনে হত কোনো একসময় হয়তো কোনো নদীপথ ছিল এই সব এলাকায়। আপনি ইতিহাস তুলে ধরলেন। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Essay [রচনা]- মাহে রমযান

250 YEARS OLD BEGUNBARI KALI PUJA, PANSKURA, WB, INDIA

----- HISTORY OF PANSKURA [WB, INDIA] [PART-1] -----