Thursday, 14 October 2021

আঠারো হাত দুর্গা- পাঁশকুড়ার অনন্য পুরাকীর্তি ফলক

 

আঠারো হাত দুর্গা- পাঁশকুড়ার অনন্য পুরাকীর্তি ফলক

©রূপেশ সামন্ত


দেবতারা নিজ নিজ বাসস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। মহিষাসুরের কাছে পরাজিত হয়ে দেবতার তখন চরম দুরবস্থার মধ্যে। তাঁরা প্রথমে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। এরপর ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা নারায়ণের কাছে গেলেন। সেখানে একই আসনে আসীন রয়েছেন শিব ও বিষ্ণু। তাঁরা দুই দেবতার নিকট মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরলেন এবং সহায়তা প্রার্থনা করলেন। দেবতারা বললেন, ‘এখন আমরা আপনাদের শরণাপন্ন। আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করুন। না হলে আমাদের রসাতলে আশ্রয় নিতে হবে’। একথা শুনে ক্রুদ্ধ শংকর দাবানলের মতো রাগে জ্বলে উঠল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সহ সমস্ত ক্রুদ্ধ দেবতাদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো এক জ্যোতির্ময় তেজ। এই তেজোরাশি এক বিশাল পর্বতশৃঙ্গের আকৃতি নিল এবং কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে একত্রিত হল। কাত্যায়ন মুনি নিজ তেজে সেই তেজোরাশিকে আরো শক্তিশালী করলেন। সেই তেজোরাশি থেকে আবির্ভূতা হলেন সহস্র সূর্যের মতো উজ্জ্বল অষ্টাদশভূজা দেবী কাত্যায়নী।

মহেশ্বরের তেজে কাত্যায়নীর মুখ, অগ্নির তেজে তিনটি চোখ, যমের তেজে চুল, হরির তেজে আঠারোটি হাত, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে শরীর মধ্যস্থান, বরুনের তেজে উরু-জঙ্ঘা-নিতম্ব, ব্রহ্মতেজে পা, সূর্য ও ইন্দ্রের তেজে কান, অশ্বিনীদ্বয়ের তেজে ভ্রু গঠিত হল।

শিব তাঁকে দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন সুদর্শন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনুক, সূর্য দিলেন তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, কুবের দিলেন গদা, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, কাল দিলেন খড়্গ ও ঢাল এবং বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। এইভাবে অস্ত্রসজ্জিতা হয়ে দেবী কাত্যায়নী সিংহ বাহিনী হয়ে চলে গেলেন বিন্ধ্য পর্বতে। হরিবংশ গ্রন্থে দেবী অষ্টাদশভূজাকে নিম্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে-

অষ্টাদশভূজা দেবী দিব্যাবরণভূষিতা।

হারশোভিতাসর্বাঙ্গী মুকুটোজ্জ্বলভূষণা।।

কাত্যায়নী স্তূয়সে ত্বং বরমগ্রে প্রযচ্ছসি।

     সেখানে চণ্ড ও মুণ্ড নামে অসুরদ্বয় তাঁকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাদের রাজা মহিষাসুরের নিকট দেবীর অপরূপ রূপ বর্ণনা করেন। মহিষাসুর দেবীকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দেবী জানান, ‘যে ব্যক্তি তাদের বংশের রমনীকে যুদ্ধে জয় করতে পারবে সেই তার পতি হবে’। মহিষাসুর মহিষের রূপ ধরে দেবীকে আক্রমণ করেন। দেবী তাঁকে তীব্র পদাঘাত করেন। এরপর দেবী অচৈতন্য মহিষাসুরের মস্তক ছিন্ন করলেন।

     ‘বামন পুরাণ’ পাঠ করলে এই কিংবদন্তীটি আমরা পাই। ‘বামন পুরাণে’র অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ অধ্যায়ে এই কাহিনীর বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। কাত্যায়নী হলেন হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিশেষ রূপ। পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর অষ্টাদশভূজা দুর্গার এই রূপটির অনন্য সাধারণ পোড়ামাটির ফলক রয়েছে মাইশোরার মাংলইয়ের রাধাদামোদরজিউ মন্দিরে। মন্দিরের দেওয়ালের অসংখ্য টেরাকোটা ফলকের মধ্যে এই বিশেষ ফলকটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। এই মন্দিরের দুই দিকে বিস্ময়কর ভাবে ঘিরে রয়েছে দু’টি শিব মন্দির। ©রূপেশ সামন্ত

[এ সম্পর্কিত আরও বিস্তৃত তথ্য সম্বলিত আমার লিখিত পুস্তক আসছে খুব শীঘ্রই। আপনারা অনুসরণ করতে পারেন। দয়া করে কেউ কপি-পেস্ট করবেন না। ভালো লাগলে শেয়ার করুন।]

No comments:

Post a Comment

জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

  জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল? জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠি...