Saturday, 19 September 2020

গোবিন্দনগরের রাধাগোবিন্দ মন্দির বাংলার অন্যতম পুরাকীর্তির নিদর্শণ: Terracotta Temple

 

গোবিন্দনগরের রাধাগোবিন্দ মন্দির বাংলার অন্যতম পুরাকীর্তির নিদর্শণ

©রূপেশ সামন্ত


     বর্ধমানের রাজা তিলোকচাঁদের (রাজত্বকাল ১৭৪৪-১৭৭১) মৃত্যুর পর রাজা হন তাঁর ছেলে তেজচাঁদ (রাজত্বকাল ১৭৭১-১৮১৬)। তখন তেজচাঁদের বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। ফলে অভিভাবিকা রূপে রাজ্য পরিচালনা করতেন তাঁর মাতা বিষনকুমারী। রাজা তেজচাঁদের আমলেই সর্বাধিক মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। উড়িষ্যা নিবাসী জনৈক নন্দনন্দন গোস্বামী ছিলেন রাজার গুরুদেব। নন্দনন্দন গোস্বামীর পিতা ছিলে প্রাণগোবিন্দ গোস্বামী। এনারা ছিলেন রাজ অনুগ্রহ প্রাপ্ত ব্রাহ্মণ। রাজ আনুকুল্যে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে দাসপুর-১ ব্লকের গোবিন্দনগর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় টেরাকোটা শোভিত পঞ্চরত্ন মন্দির। এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল রাধারানি, রাধারমন ও রাধাগোবিন্দ জীউর বিগ্রহ। দেবতার নিত্যপূজা পরিচালনার জন্য রাজা ৩৬৫ বিঘা জমি সহ নন্দনন্দন গোস্বামীকে মন্দিরের সেবাইত নিযুক্ত করেন। টেরাকোটা ফলকে শোভিত পঞ্চরত্ন মন্দিরটি প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন।


     মন্দিরের সামনের দেওয়ালে রক্ষিত ফলকে লিখিত রয়েছে, ‘শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জীউ চরণ পরায়ন/ সন ১১৮৮ সাল তারিক ১৫ মাগে পুন্নিমা কাজের/ দাসপুর।। আরভ কারীকর শ্রী সফল/ রামচন্দ্র মিস্ত্রী’। অর্থ্যাৎ মন্দিরটি প্রায় ২৫০ বছর আগে বাংলা ১১৮৮ সালে এবং ইংরাজী ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মন্দিরের বিগ্রহ গুলিও প্রাচীন। মন্দিরে রয়েছে রাধারানীর অষ্টধাতুর বিগ্রহ এবং রাধারমন জীউ ও রাধাগোবিন্দ জীউর কষ্টিপাথরের বিগ্রহ।  পাঁচ পোয়া চাল ও পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে দেবতার তিনবার ভোগ হয়। এছাড়াও একবার বাল্যভোগ হয়। প্রতিদিন ৫০ জন ভোগের প্রসাদ পায়। এখানে পালিত সবচেয়ে বড় উৎসব হল ঝুলন। এছাড়াও রাস, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উৎসব উদযাপিত হয়। মন্দিরের বর্তমান প্রধান সেবাইত সতীশচন্দ্র গোস্বামী ও অজিত গোস্বামী। ©রূপেশ সামন্ত


     টেরাকোটা ফলক শোভিত অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরটি বাংলার মন্দির পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শণ। পঞ্চরত্ন রীতির পূর্বমুখী মন্দিরটি প্রদক্ষিণ-পথ সহ একটি উঁচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের সম্মুখে ত্রিখিলান প্রবেশপথ রয়েছে। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে ভোগশালাতে যাওয়ার জন্য একটি দ্বারপথ রয়েছে। মন্দিরের মাথার রত্নগুলি ওড়িয়া ধারায় রথবিন্যাস যুক্ত। বর্গাকার মন্দিরটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৩ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট।


     গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্য রয়েছে একখিলান প্রবেশপথ। খিলানের উপর ভল্টের সাহায্যে গড়া গর্ভগৃহের সিলিং। মন্দিরের দক্ষিণদিকে রয়েছে একটি রাসমঞ্চ। মন্দিরের সামনের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে টেরাকোটার অজস্র ফলক। ফলকগুলি লাগানো রয়েছে মন্দিরের প্রবেশপথের চারটি স্তম্ভের গায়ে ও ত্রিখিলান প্রবেশ পথের মাথায় ৩টি আলাদা আলাদা ব্লকে। এছাড়াও মন্দিরের কার্নিশের নীচে দুটি সমান্তরাল সারিতে ছোট ছোট খোপে ও সম্মুখস্থ দুটি কোনাচ অংশের পাশে ২টি উল্লম্ব সারির ছোট ছোট খোপে টেরাকোটা ফলক গুলি লাগানো রয়েছে। ©রূপেশ সামন্ত


      মন্দিরের ত্রিখিলান প্রবেশপথের মাথায় শিবলিঙ্গ যুক্ত পীঢ়া দেউলের টেরাকোটা ফলক রয়েছে। মাঝখানের খিলানে ১৩টি, দুপাশের দুটিতে ১০টি করে এরূপ ফলক রয়েছে। এছাড়াও প্রবেশপথের মাথায় তিনটি ব্লকে ময়ূর, দশভূজা দুর্গা, রাম-রাবনের যুদ্ধ, কৃষ্ণ লীলা প্রভৃতি দৃশ্যের টেরাকোটা ফলক রয়েছে। প্রবেশপথের স্তম্ভগুলিতে রাধা-কৃষ্ণ, নৌকাবিলাস দৃশযুক্ত ফলকের আধিক্য রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে খোপ গুলিতে কপালকুণ্ডলা, রাধাকৃষ্ণ, নারী যোদ্ধা, শায়িত বিষ্ণু প্রভৃতি দৃশ্যযুক্ত টেরাকোটা ফলক রয়েছে। কিছু মিথুন দৃশ্যও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গর্ভগৃহের কাঠের দরজাটিও বেশ অলংকৃত। দরজায় অলংকৃত নকশা এবং মূর্তিগুলি উৎকৃষ্ট শিল্পরুচির পরিচয় বহন করে। ©রূপেশ সামন্ত


     এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি। মন্দিরের সেবাইতগন সূত্রে জানা যায়, এই বছরই মন্দিরটি ৩৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে সরকারীভাবে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু সংস্কারের কাজটি অত্যন্ত অদক্ষতার সঙ্গে ও অবৈজ্ঞানিক ভাবে সম্পাদন করা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। সঙরক্ষণের কাজ নিম্ন মানের হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল।




      বাসে বা ব্যক্তিগত মোটর গাড়িতে মন্দিরস্থলে যাওয়া যায়। পাঁশকুড়ার ষ্টেশন থেকে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়কে প্রায় ১৭ কিমি দূরে গৌরা বাসস্টপ। সেখানে নেমে ১.৫ কিমি পশ্চিমে এই মন্দিরটি অবস্থিত। ©রূপেশ সামন্ত

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার- সত্যরঞ্জন গোস্বামী, ক্ষেত্রসমীক্ষা- ১৫.০৯.২০]

বি.দ্রঃ কেউ কপি-পেস্ট করবেন না। শেয়ার করুন। অন্যান্য লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমার ব্লগে-

Thursday, 17 September 2020

 

রান্নাপূজা-  হাওড়া জেলার অনন্য লোক উৎসব

©রূপেশ সামন্ত


     রান্নাপূজা কি?

     রান্নাপূজা কেবল একটি সাধারণ পূজা নয়, এটি হাওড়া জেলার আঞ্চলিক উৎসবও বটে। এটিকে অরন্ধন উৎসবও বলে। আবার এই পূজাকে কেন্দ্র করে চলে রন্ধনও। মনসা দেবীকে উদ্দেশ্য করে পূজার অর্ঘ্য উৎসর্গীকৃত হয়। অর্থ্যাৎ রন্ধনও অরন্ধনের মিশেলে মনসাদেবীর উদ্দেশ্যে পূজার এক অনবদ্য আয়োজন।  ভাদ্রমাসে মাঠ-ঘাট-পুকুর-রাস্তা সব বর্ষার জলে ডুবে যায়। এইসময় বিষধর সাপেরা লোকালয়ে এসে আশ্রয় নেয়। অসাবধানতায় মানুষকে ছোবলও মারে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল মৃত্যু। তাই এইসময় মানুষ সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য দেবী মনসাকে তুষ্ট করতে এই পূজার আয়োজন করে। এই পূজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষরা অরন্ধন উৎসবে মেতে ওঠে। অর্থ্যাৎ রান্না না করে দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত নৈবেদ্য, যা প্রসাদ স্বরূপ পান্তাভাত ও বাসি তরকারি খাওয়া হয়। আবার দেবীকে উৎসর্গীকৃত নৈবেদ্যগুলো সবই আগের দিন রান্না করা। অর্থ্যাৎ রন্ধনও হয়। তাই এই সময়ের মনসা পূজাকে ‘রান্নাপূজা’ বলা হয়।

 

নানা নামে রান্নাপূজা

     এই রান্নাপূজা বিভিন্ন নামে পরিচিত। সব রান্নাপূজার নিয়মকানুন মোটামুটি একরকম। পার্থক্য শুধু সময়ের হেরফেরে। ভাদ্র মাসের যে কোন শনিবার ও মঙ্গলবার সাধারণ ভাবে যে রান্নাপূজা হয় তাকে ইচ্ছেরান্না বলে। এতে এক একটি পরিবার তাদের ইচ্ছেমতো দিন ঠিক করে রান্না পূজো করে। ষষ্ঠীর দিন যে রান্নাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তাকে ষষ্ঠীরান্না বলে। আবার, ভাদ্র মাসের আটাশ দিনের মাথায় যে রান্নাপূজা হয়ে থাকে, তাকে আঠাশে রান্না বা গাবড়া রান্না বলে। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন রান্না আর সংক্রান্তির দিন পান্না বা রান্নাপূজা হয়। মাসের শেষ দিনে হয় বলে একে বুড়ো রান্না বলে।

 রান্নাপূজার রান্না

      প্রথা অনুসারে, সূর্য ডোবার পর থেকে রান্নার কাজকর্ম শুরু হয়। আবার সূর্য ওঠার আগে রান্নার কাজকর্ম শেষ করতে হয়। রান্নার দিন সকাল থেকে পূজার আয়োজন চলে। নতুন উনুন তৈরি করা হয়। বহু রকমের আনাজ, মাছ, মশালা ইত্যাদি যোগাড় করা হয়। সূর্য ডোবার পর ভোগের হাঁড়িতে চাল ও জল দিয়ে উনুনে বসানো হয়। গৃহিনীরা নতুন বস্ত্র পরে রান্নার কাজকর্ম করে। রান্না চলাকালীন কেউ কথা বলতে পারে না। এরপর অন্যান্য রান্না গুলো হয়। রান্নার পদগুলি বিজোড় রাখতে হয়। নানান মুখরোচক পদ রান্না হয়-

ভাজাভুজি- শাকভাজা, নারকেল ভাজা, ঝিঙেভাজা, চিচিঙ্গাভাজা, ঢেঁড়সভাজা, বেগুনভাজা, ওলভাজা, আলুভাজা, শশাভাজা, পটলভাজা, কুমড়াভাজা, কাঁচকলাভাজা, পেঁপেভাজা, উচ্ছেভাজা ইত্যাদি।

ডাল- ডালের ক্ষেত্রে খেসারির ডাল ব্যবহারের রীতি রয়েছে।

তরকারি- সারকচুর ডাঁটার তরকারি, পুঁইশাকের তরকারি, চালকুমড়োর তরকারি ইত্যাদি রান্না করা হয়।
মাছের পদ- ইলিশ মাছের সরষে বাটা, চিংড়ির মালাইকারি, কাটাপোনার ঝাল ইত্যাদি।

অম্বল বা টক- পাকা তেঁতুল, কুমড়ো, ঢেঁড়স, চিংড়ি মাছ বা ইলিশ সহযোগে অম্বল। অথবা চুনোমাছ দিয়েও হয়।

পায়েস- নারকেল, দুধ, চিনি ও আতপচাল দিয়ে পায়েস তৈরি হয়।

 

পূজা-পদ্ধতি

     এরপর একটি ভোগের হাঁড়িতে জল দিয়ে পান্না করা হয়। সূর্য উদয়ের পর একটি পরিস্কার ঘরে একটি মনসা গাছ স্থাপন করা হয়। রান্নার ভাত তরকারি দুটি থালায় সাজিয়ে মনসা গাছের সামনে রাখা হয়। এছাড়াও চাল, কলা ও দুধের পাত্র নৈবেদ্য হিসাবে রাখা হয়। পুরোহিত সাধারনত পূজা করে। অনেক ক্ষেত্রে রান্নাঘরে উনুনের চারিদিকে মনসা গাছের ডাল, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ও আলপনা দেওয়া হয়।

 

ভোজন উৎসব

     পূজার দিন বাড়িতে উনান জ্বালানো হয় না। তাই ঐদিন রান্নার প্রশ্নই নেই। এই অরন্ধন উৎসবে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রিতরা রান্নাপূজার প্রসাদ ভক্তিভরে ও আনন্দ সহকারে খায়। হাওড়া জেলায় মনসা দেবীকে উৎসর্গ করে বাড়ি বাড়ি রান্নাপূজা হয়। সর্পকূলের হাত থেকে রক্ষা পেতে কলকাতার পাশের এই কলকারখানা অধ্যুসিত জেলাতে আজও রান্নাপূজা সমান উৎসাহে অনুষ্ঠিত হয়। বিস্ময় জাগে, মেদিনীপুরের মতো জল-জঙ্গলময় সর্প অধ্যুসিত জেলাতে এই পূজার ব্যাপকতা না থাকায়। ‘মনসামঙ্গলে’র কাব্যপটের মেদিনীপুর জেলায় মনসাপূজার ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে তুলসী মঞ্চের পাশে মনসা গাছে পূজিতা হন দেবী মনসা। আসলে রান্নাপূজা হাওড়া জেলার নিজস্ব লোকসংস্কৃতির অঙ্গ।

©রূপেশ সামন্ত

[কেউ কপি-পেস্ট করবেন না। শেয়ার করুন।]

মহালয়া Mahalaya

 

মহালয়া শুভ, নাকি অশুভ? হিন্দু শাস্ত্র কি বলে?

© রূপেশ সামন্ত


প্রতি চান্দ্রমাসে দুটি পক্ষ রয়েছে- শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষ। প্রতিটি পক্ষ ১৫ দিনের হয়। এইভাবে বছরের ১২মাসে ২৪টি পক্ষ হয় এর মধ্যে ২টি পক্ষ তাৎপর্য্যপূর্ণ। একটিল পিতৃপক্ষ ও অন্যটি হল দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষএই পিতৃপক্ষের শেষ এবং মাতৃপক্ষের শুরুর দিনটিকে বলা হয় মহালয়া। মহালয়া শব্দটির অর্থ মহান আলয়। পিতৃপক্ষে স্বর্গত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ ও তর্পন করা হয়। এই সময় পিতৃলোক বা যমালোক থেকে মর্ত্যলোকে প্রয়াত পিতৃ পুরুষেরা আসেন। ফলে প্রয়াত আত্মামহা যে সমাবেশ ঘটে, তাকে মহালয় বলা হয়। আর এই মহালয় থেকে স্ত্রী লিঙ্গে মহালয়া শব্দটি এসেছে পিতৃপুরুষদের তৃপ্ত করার জন্য তিল, জল সহযোগে ‘পিণ্ড’ দান করা হয় অন্য মতে, পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের আগমন হয়। তখন দেবী দুর্গাই হলেন আমাদের মহান আশ্রয়। তাই এই লগ্নটির নাম মহালয়া। আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যা পড়ে, তাকে আমরা মহালয়া হিসাবে চিহ্নিত করি।

-----রামায়ন যোগসূত্র-----

 পিতৃপক্ষের শেষ দিনটি অমাবস্যা হয়। এই অমাবস্যায় পিতৃপূজা সেরে পরের পক্ষে দেবীপূজায় প্রবৃত্ত হতে হয়। পিতৃপক্ষে আত্নসংযমের মধ্য দিয়ে দেবী পক্ষে শক্তি সাধনায় উত্তীর্ণ হতে হয়। হিন্দু ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে পিতৃপুরুষদের জন্য তর্পণ করতে হয় রামায়নে ভগবান শ্রীরামচদ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এই দিনে পিতৃ তর্পণ করেছিলেন। এরপর দেবীপক্ষে শরৎকালীন দুর্গা পূজা বা অকালবোধনে ব্রতী হয়েছিলে।

-----মহাভারত যোগসূত্র-----

মহাভারত অনুসারে, মৃত্যুর পর মহাবীর দাতা কর্ণের আত্মা পিতৃলোকে গেলে সেখানে তাঁকে শুধুই সোনা আর ধনরত্ন খেতে দেওয়া হল কর্ণ কারণ জিজ্ঞাসা করলে দেবরাজ ইন্দ্র বললেন যে তার হাতে পিতৃপুরুষ জল পায়নিকর্ণ কেবলই সারাজীবন সোনা ধনরত্ন বিলিয়েছেন। তাই কর্ণের জন্যে এই ব্যবস্থা। তখন কর্ণ বললেন যে তার কোন দোষ নেই। কেননা সে তার পিতৃপুরুষের কথা জানতো না। যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে মা কুন্তী তার পূর্ব পুরুষদের পরিচয় ব্যক্ত করেছিলেন। তারপর যুদ্ধে কর্ণের মৃত্যু হয়ফলে তিনি পিতৃতর্পণের সময় পান নি। ইন্দ্র কর্ণের দোষ খুঁজে পেলেন না। তাই তিনি কর্ণকে এক পক্ষকাল মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন। তখন কর্ণ এক পক্ষকাল ধরে মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিলেন। তাঁর পাপস্খালন হল। সেই পক্ষটি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হল

----গরুড় পুরান যোগসূত্র----

মহালয়া তিথিতে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়। তারা উত্তরসূরিদের  আশীর্বাদ প্রদান করেন। পিতৃপক্ষে পুত্র কর্তৃক এই তর্পণ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশ করতে পারেনগরুড় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পুত্র ছাড়া মুক্তি নাই। গৃহস্থ দেবতা, ভূত ও অতিথিদের সঙ্গে পিতৃতর্পণের কথা বলা হয়েছে।

----মার্কণ্ডেয় পুরাণ যোগসূত্র----

মার্কেণ্ডেয় পুরানে বলা হয়েছে, পিতৃপুরুষ শ্রাদ্ধে সতুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু প্রাপ্তির আশীর্বাদ প্রদান করেন। এছাড়াও উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।

-----তিন পুরুষের শ্রাদ্ধ----

বিশ্বাস অনুযায়ী, স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে রয়েছে পিতৃলোক। এই পিতৃলোকেই রয়েছে মৃত্যুদেবতা যমরাজ। তিনিই মৃতের আত্মাকে নিয়ে যান। এই পিতৃলোকে জীবিত ব্যক্তির আগের মৃত তিন পুরুষ বাস করেন। জীবিত প্রজন্মের কারো মৃত্যু হলে সেই আত্মা পিতৃলোকে গমন করে এবং পিতৃলোক থেকে আগের প্রজন্মের একটি আত্মা স্বর্গে গমন করে। সেখানে পরমাত্মা বা ঈশ্বরে লীন হয়ে যায়। তখন তার আর শ্রাদ্ধের প্রয়োজন হয়না। তাই কোন জীবিত ব্যক্তি কেবল পূর্ববর্তী তিন পুরুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে পারে। একেই বহুক্ষেত্রে ‘তিন পুরুষের শ্রাদ্ধ’ বলা হয়। যেহেতু এই মহালয়ার সঙ্গে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধের মতো বিষয় জড়িয়ে রয়েছে তাই একে শুভদিন বলা মোটেই বাস্তব সম্মত নয়। আবার অন্যমতে, যেহেতু এই মহালয়ার মধ্য দিয়ে পিতৃপুরুষদের স্মরণ করার মতো মহতী কর্ম করা হয়, তাই এই দিনটি শুভ।

-----মহালয়ার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান-----

মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় নদী তীরে বা গৃহে। মৃত ব্যক্তির পুত্র বা পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী পূর্বপুরুষকে রান্না করা খাদ্য উৎসর্গ করা হয় রুপোর পাত্র, তামার পাত্র বা কলাপাতার উপর স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে খালি গায়ে শ্রাদ্ধ করতে হয়। শ্রাদ্ধের সময় সিদ্ধ অন্ন, ময়দা, ঘি ও তিল দিয়ে মাখিয়ে পিণ্ড তৈরী করে উৎসর্গ করা হয়। একে পিণ্ডদান বলে। শ্রাদ্ধে বিষ্ণু এবং যমের পূজা করা হয়। এই খাদ্য যদি কোনো কাক এসে খেয়ে যায়, তাহলে ধরা হয় যে খাদ্য পিতৃগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। খাদ্য গোরু ও কুকুরদেরও খাওয়ানো হয়। এরপর ব্রাহ্মণ ভোজন হয়। কাক রূপী পূর্বপুরুষের প্রতিনিধি এবং ব্রাহ্মণ ভোজনের পর অন্যান্যরা ভোজন করে।

-----সামাজিক তাৎপর্য----

মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতীত প্রজন্মকে ভুলে যায়। কিন্তু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্পর্কের সূদৃঢ বন্ধনের মধ্য দিয়েই একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার জন্মলাভ করতে পারে। এই পিতৃ তর্পণের মধ্য দিয়েই পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয় তাঁদের নাম এবং গোত্রকে স্মরণ করা হয়। ফলে একজন ব্যক্তিকে মৃত তিন পুরুষ ও জীবিত তিন পুরুষ অর্থাৎ মোট ছয় প্রজন্মের নাম স্মরণে রাখতে হয়। এর ফলে বংশের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়। পারিবারিক ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এছাড়াও এর মধ্য দিয়ে পিতৃপুরুষের ঋণ স্বীকার করার নৈতিক দিকটিও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

তথ্যসূত্র- গরুড় পুরান, মার্কেণ্ডেয় পুরান, উইকিপিডিয়া, অষ্টাদশ পুরান সমগ্র- কামিনী প্রকাশনালয়, কৃত্তিবাসী রামায়ন, মহাভারত।

Tuesday, 15 September 2020

শরৎচন্দ্রের সামতাবেড়ের বাড়ি Sharatchandra

 

আজ শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে ঘুরে আসুন দেউলটির বাড়ি

©রূপেশ সামন্ত


     মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। মামার বাড়ি গেলেই শরৎচন্দ্রের দেউলটির সামতাবেড়ের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম। আমার মামাবাড়ি সামতাবেড়ের পাশের গ্রাম মেল্লকে। শরৎচন্দ্রের বাড়ি রূপনারায়ণের তীরে শান্ত-নিরিবিলি ছবির মতো সাজানো পরিবেশে। অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের বাড়িতে দু’দণ্ড বসলে রূপনারায়ণের শীতল হাওয়া জুড়িয়ে দেবে মন-প্রাণ।

     ১৮৭৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহন হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। মধ্যবয়সে শরৎচন্দ্র এই সামতাবেড় গ্রামের মাটির বাড়িতে বাস করতেন। এখানে কাটিয়ে ছিলেন জীবনের বারোটি বছর। দেউলটি স্টেশন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ। বাড়ির সামনে পাশাপাশি দুটো পুকুর রয়েছে। পুকুরে রয়েছে বাঁধানো সানের ঘাট। পুকুরের পাশে বাগানে রয়েছে ডালিম, পেয়ারা গাছে প্রভৃতি ফলের গাছ। ১৯৭৮ সালের প্রবল বন্যায় পাশাপাশি সব বাড়ি ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ভাঙেনি শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়ি। একুস্ময় শরৎচন্দ্র বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে পঁচাত্তর টাকা মাইনের কেরেনিগিরির চাকরি করতেন। রেঙ্গুনের বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে বসবাস করতেন। ফলে তাঁর সামতাবেড়ের বাড়িটিতে বার্মা স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। বর্তমানে বাড়িটির জানালা পর্যন্ত ইঁট-সিমেন্টে গাঁথা। সরকারি উদ্যোগে কিছুটা মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে।


     শরৎচন্দ্র লেখালেখির সময় পাশ দিয়ে প্রবহমান রূপনারায়ণের দিকে তাকিয়ে মনের খোরাক যোগাতেন। এখন নদীটি খাত পরিবর্তন করে দূরে সরে গেছে। এই বাড়িতে বসেই শরৎচন্দ্র অভাগীর স্বর্গ, কমললতা, শেষপ্রশ্ন, পল্লীসমাজ, রামের সুমতি, পথের দাবী  মহেশ-এর মতো গল্প-উপন্যাসগুলি লিখেছিলেন। শরৎচন্দ্র ও তার ভাই স্বামী বেদানন্দ এই বাড়িতে থাকতেন। বেদানন্দ বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী ছিলেন। এই বাড়ির পাশে আজও রয়েছে তাঁদের সমাধি মন্দির। শরৎচন্দ্রের নিজের লাগানো গুলঞ্চ, পেয়ারা গাছ এই বাড়িতে এখনও রয়েছে। বাড়িটি দোতলা। বাড়িটিতে রয়েছে বার্মা কাঠের আসবাবপত্র। রয়েছে তাঁর লেখার ডেস্ক, জাপানি ঘড়ি, ব্যবহৃত পোষাক, বইয়ের তাক, হুঁকো ইত্যাদি। সবই সজত্নে সংরক্ষিত। রয়েছে শরৎচন্দ্রের হোমিওপ্যাথি ওষুধের চেম্বার। দরিদ্র মানুষদের বিনাপয়সায় চিকিৎসা দিতেন তিনি। রয়েছে একটি পাখির খাঁচাও। পাখি পোষার শখ ছিল শরৎচন্দ্রের।


     ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারী যকৃতের ক্যান্সারে শরৎচন্দ্রের মৃত্যু হয়। প্রতিবছর জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে এখানে বড় আকারের ‘শরৎ মেলা’ বসে। বড়দিদি, বিরাজবৌ, পন্ডিতমশাই, পল্লী-সমাজ, চন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত, দেবদাস, চরিত্রহীন প্রভৃতি উপন্যাস প্রণেতার বাড়ি একবার ঘুরে আস্তে পারেন।

©রূপেশ সামন্ত


 

Monday, 14 September 2020

তপ্ত দুপুরের পলাশপাই Palashpai River

 

তপ্ত দুপুরের পলাশপাই

© রূপেশ সামন্ত


     এই তপ্ত দুপুরে কুলকুল বয়ে চলে পলাশপাই। ভরা ভাদ্রেও ক্ষীণকায়া। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ব্লকের একটি নদী। তবে সেচ দপ্তরের নথিতে এটি একটি খাল। বসন্তপুর থেকে মহিষঘাটা পর্যন্ত দৈর্ঘ প্রায় ২০ কিলোমিটার। এটি পুরাতন কাঁসাইয়ের শাখানদী। পলাশপাই গ্রামের নাম অনুসারে নদীটির নাম পলাশপাই।

     এই পলাশপাই নদী বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী। পলাশপাইয়ের তীরে রয়েছে জ্যোতঘনশ্যাম গ্রাম। ব্রিটিশ আমলে এই গ্রাম ছিল লবন আইন অমান্য আন্দোলনকারীদের অবাধভূমি। ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে আন্দোলনকারীরা রক্তাক্ত হয়েছিল। দাসপুর থানার অত্যাচারী ভোলা দারোগার নেতৃত্বে মুগুর দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনকারীদের হাত-পায়ের আঙ্গুল। হাত-পা বেঁধে গরম বালিতে শুইয়ে রাখা হয়েছিল আন্দোলনকারীদের। একবিন্দুও জলপান করতে দেওয়া হয়নি। সেদিন নারীরা ব্রজবালা কুইলা ও মেনকা মাইতির নেতৃত্বে তৃষ্ণার্ত আন্দোলনকারীদের বুকের দুধ পান করিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলেছিলেন। © রূপেশ সামন্ত

     পলাশপাইয়ের তীরের চেঁচুয়া হাট স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেক রক্তাক্ত ইতিহাসের স্বাক্ষী। লবন আইন অমান্য আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই চেঁচুয়া হাট। ভোলা দারোগার অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে বিপ্লবী মৃগেন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৩০ সালের ৩রা জুন আন্দোলনকারীরা অতর্কিতে চেঁচুয়াহাটের পুলিশ ক্যাম্প আক্রমন করে অত্যাচারী ভোলা দারোগা ও তাঁর সঙ্গী অনিরুদ্ধ সামন্তকে হত্যা করে। এরপর ব্রিটিশ পুলিশ স্থানীয় গ্রামগুলিতে নামিয়ে আনে অকথ্য অত্যচার। প্রতিবাদে স্থানীয়রা ৬ই জুন প্রতিবাদ সভার ডাক দেন। সেই প্রতিবাদ সভায় ব্রিটিশ পুলিশ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালায়। পলাশপাইয়ের জল সেদিন রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। শহীদ হয়েছিলেন ১৪ জন।

     পলাশপাইয়ের তীরে গঙ্গামাড়োতলায় প্রতিবৎসর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে বসে গঙ্গাবারুণী মেলা। মেলাটি প্রায় ২৫০ বৎসরের প্রাচীন। রয়েছে নবনির্মিত গঙ্গা মন্দির। মন্দিরে পূজিত গঙ্গার প্রাচীন দারুবিগ্রহটি নিমকাঠের। গঙ্গার এইরূপ দারু বিগ্রহ বাংলায় আর কোথাও নেই। এখানেই রয়েছে গঙ্গাধর শিবের আটচালা জীর্ণ মন্দির।

     পলাশপাইয়ের তীরে গোবিন্দনগরে রয়েছে গোস্বামীদের প্রাচীন রাধাগোবিন্দজীউর পঞ্চরত্ন মন্দির। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে। মন্দিরটি টেরাকোটা শিল্পের অনন্য নিদর্শণ। এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বুকে বহন করে এই তপ্ত দুপুরেও একই ভাবে প্রবহমান সেই পলাশপাই।

    © রূপেশ সামন্ত

[তথ্যসূত্র- মেদিনীপুরের নদ-নদী কথা, সম্পাদনা- তাপস মাইতি, পলাশপাই, আশিস হুদাইত, Bengal District Gazetteers- Midnapore, LSS O’Malley]

[কপি-পেস্ট বেয়াইনি। শেয়ার করুন। ভিজিট করুন- ]

Sunday, 13 September 2020

তাল

 

আহা! তাল

©রূপেশ সামন্ত




 

দেবের দুর্লভ ধন জীবনের ঘড়া

এক বিন্দু রস খেলে বেঁচে ওঠে মড়া।

     লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। রস পাগল মানুষদের দেখলে কবিতার সারমর্ম উপলব্ধি হয়। তালরস থেকে খেজুররস বাঙালী হৃদয়ে চিরকালই দোলা দেয়। খেজুর কুল থেকে খেজুরের রসে যেমন শীতকাল ‘ম’ ‘ম’ হয়ে ওঠে, তেমনি তালরস থেকে তালপাঁকিতে গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা জীভ জলময় হয়ে ওঠে। তালরস থেকে তালগুড়, তালমিছরি, তাড়ি নানারকম দ্রব্য তৈরি হয়। এগুলির মধ্যে তাড়ি এক বিষম বস্তু! আবার অতি চাহিদারও বস্তু! গ্রীষ্মকালে গ্রামে-গঞ্জে জাঁকিয়ে বসে তাড়ি তৈরির কারখানাও! তাই কবিতা প্রেমিক বলদেব সাঁতরা কবিতায় লেখেন-

রসের ও লাগিয়া, হাঁড়ি গাছে পাতিয়া --

ধরিব শীতল জল বিন্দু।

তোমার কাছে আছে কি খোঁজ বন্ধু,

কেমনে জুটিবে এমন সুধা সিন্ধু?”

     রসবন্ধু বেরা নামে এক রেল কর্মচারী ছিল। তিনি সখের তালবাগান করেছিলেন। রসভক্ত রসবন্ধু তালরস পান না করে দাঁত মাজতেন না! প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় দু’চার বোতল রস সঙ্গেও নিয়ে নিতেন। তালরসে অফিসের বসও বশীভূত! আবার অফিস ফেরৎ হয়ে তালরস পান না ডিনার করতেন না! রসেবসে রসবন্ধু ভালোই ছিলেন! ধীরে ধীরে খরিদ্দারও হতে লাগলো! রসবন্ধুর নাম হয়ে গেল তাড়িবন্ধু! সেই তাড়ি একসময় রসবন্ধুকে তাড়া করে বেড়ালো তাড়ির সঙ্গে আর আড়ি করতে পারলেন না! একদিন শুনলাম, চাকুরি জীবন শেষ করার পূর্বেই অতিরিক্ত তাড়ি পানের তাড়নায় মারা গেছেন তাড়িবন্ধু! কবিতা প্রেমিক বলদেব বাবু উপসংহার টানলেন-

এরকম লোকের আজকে খুবই অভাব। রসের প্রকৃত রসবোধ এমন জীবন রসিকরাই জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে বাকিরা চুমুকেই ডিগবাজিস্বাদ কি বুঝিবে, গন্ধেই মরিয়া গেল। ©রূপেশ সামন্ত


     এ তো গেল রসকথা। রসে যেমন বাঙালি মাতাল, পাকা তালে তাল ঠিক রাখাটাও বাঙালির কাছে মুস্কিল! পাকা তালের গন্ধে মনটা উসখুস করে উঠবেই। তালের রুটি, তালের পরোটা, তালের নানান পিঠা, তালের পায়েস সবই বাঙালির নিজস্ব সৃষ্টি। ভাদ্রমাস মানেই ঘরে ঘরে তালের বড়া, তালের পুরপিঠা, তালের পোড়াপিঠা হবেই। ফলে তালের চাহিদা ক্রম বর্ধমান। যে তাল আগে রাস্তঘাটে পড়ে থাকতো, তাই এখন বাজারে ৩০টাকা দরে বিক্রী হয়। আসলে সবের পেছনেই সেই রসনাপ্রেম। তালরস থেকে তালপাঁকি- রসাস্বাদন থেকে পিঠাস্বাদন- রসনাপ্রেমিদের জীবনকে অন্য আঙ্গিকে দেখার অভিপ্রায়েই কিনা!

©রূপেশ সামন্ত

[দয়া করে কপি-পেস্ট করবেন না। শেয়ার করুন।]


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

  জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল? জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠি...