Tuesday, 27 April 2021

পাতাধরা অনুষ্ঠান বৈষ্ণবীয় রীতি

‘পাতাধরা’ অনুষ্ঠান পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার বৈষ্ণবীয় রীতি রূপেশ সামন্ত, শিক্ষক
নিরামিষ ‘পঞ্চভাজি’ ও ‘পঞ্চব্যঞ্জন’ রান্না করে কলাপাতায় সুন্দর করে সাজানো হয়। ‘পঞ্চভাজি’ বা পাঁচরকম ভাজার মধ্যে আলুভাজা, উচ্ছেভাজা, পটলভাজা, শাকভাজা, বেগুনভাজা ইত্যাদি থাকে। ‘পঞ্চব্যঞ্জন’ বা পাঁচরকম তরকারির মধ্যে পটলের তরকারি, শুক্তো, কুমড়োর ঘন্ট, ডাল, বিচাকলার ছেঁচকি ইত্যাদি থাকে। এবার একটি আসনে পান-সুপারি-তুলসি দিয়ে মৃত পূর্বপুরুষকে ভক্তিভরে আহ্বান জানানো হয়। নানান শাস্ত্রীয় মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। আসনের সামনে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে কলাপাতায় ভোগ নিবেদন করা হয়। একই সাথে বৈষ্ণব পূর্বপুরুষদের সমাধিক্ষেত্রে ভোগের প্রসাদ নিবেদন করা হয়। উল্লেখ্য, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষদের মৃত্যুর পর সমাধিস্থ করার রীতি প্রচলিত আছে। যাইহোক, এই সমস্ত ক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন কোন বৈষ্ণব গুরু। ভোগ রান্নাও তাঁরা করেন। সমগ্র এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘পাতাধরা’। অর্থ্যাৎ ‘পাতা’য় করে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করে তাঁদের জন্মতিথি পালন করা বা ‘ধরা’ হয়। ‘পাতাধরা’ উপলক্ষে বাড়িতে গোপাল ঠাকুর আনা হয়। দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা ও ভোগ নিবেদন করা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে হরিনাম-সংকীর্তণেরও আয়োজন করা হয়। এই প্রথা আজও পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলে সচরাচর দেখা যায়। রীতি অনুসারে, বৈষ্ণব সমাধিতে জল-তুলসি দিয়ে নিত্যপূজা করতে হয়। এছাড়া সাধারণভাবে পূর্ণিমা বা অন্য কোন শুভ তিথি ধরে বৈষ্ণব পূর্বপুরুষদের আবির্ভাব তিথি পালন করা হয়। ঐ দিনটিতেই ‘পাতাধরা’ অনুষ্ঠান করা হয়। এইভাবে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ বর্তমান প্রজন্মের উপর বর্ষিত হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। সর্বোপরি, এই ধরনের রীতির মধ্য দিয়ে গুরুজন বা পূর্বপুরুষদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করার প্রাচীন সংস্কৃতি আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয়।

Wednesday, 14 April 2021

----চড়ক পূজা----- Charak Puja

----চড়ক পূজা----- ✍️ রূপেশ সামন্ত চৈত্র মাসের শেষ দিনে উদ্‌যাপিত হয় চড়ক উৎসব। চড়কের দিন সকালে গ্রাম ঘুরে 'মাগন' চাওয়া হয়। এই 'মাগনে'র মাধ্যমে সন্যাসীরা দলবদ্ধ ভাবে গ্রাম ঘুরে চাল, আলু, টাকা ইত্যাদি সংগ্রহ করে। সারা বছর ধরে চড়ক গাছকে শিবমন্দিরের কাছের কোনও পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। সেই পুকুর ‘শিবপুকুর’ নামে পরিচিত। চড়কের দিন গাছটিকে তুলে আনা হয় মন্দিরের সামনে। চড়ক গাছের উচ্চতা ৪০ ফুটের বেশি হয়। তার পর, চড়কগাছ পুজো করে তা মাঠের মাঝে পোঁতা হয়। এরপর ঘাইপূজা ও কাঁটাপূজা হয়। এর পরে শুরু হয় চড়ক অনুষ্ঠান। সঙ্গে চলে বিরাট মেলা। চড়ক গাছ থেকে পিঠে বঁড়শি গেঁথে দড়ি দিয়ে সন্ন্যাসীকে ঝুলিয়ে দিয়ে ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়ানো হয়। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্ন্যাসী নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশে ছুড়ে দেন বাতাসা, ফল ইত্যাদি। সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদেরও শূন্যে তুলে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ করেন। সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস, জগতে যারা শিব ঠাকুরের কৃপা লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছে, বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন। ©রূপেশ সামন্ত (১৪.০৪.২১)

বিবর্তনের পথে কীর্তন? Kirtan

বিবর্তনের পথে কীর্তন? ✍️ রূপেশ সামন্ত স্বামীজির মতে কীর্তন হল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত। কীর্তন হল ভাবপ্রধান গান। এতে তালের এতরকম ফের আছে যা অন্য কোন সঙ্গীতে নেই। 'গীতগোবিন্দে' একটি গান আছে যার একটা লাইনেই আটরকম তাল রয়েছে। কীর্তনের ভাষায় একে অষ্টতাল বলা হয়। এমন তাল বিশ্বের আর কোন সঙ্গীতে প্রয়োগ নেই। নেতাজী সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যেক মনীষী, দেশপ্রেমিক ও বাংলার কবিরা কীর্তন বড় ভালোবাসতেন। সাধারণ ভাবে কীর্তন মানে গান। রামায়ণ মহাভারত থেকে উদ্ধৃত কথার ব্যাখা নয়। এটাকে অনেকে তত্ত্ব বলে থাকেন। তা কিন্তু নয়। কীর্তন মানে গানের মাধ্যমে পদাবলী সাহিত্যের ব্যাখা, যাতে আত্মা ও পরমাত্মার যোগ সাধনা থাকে। কীর্তনের পরিভাষায় একে তত্ত্বকথা বলে। কীর্তন বিভিন্ন ঘরানায় হয়। তবে গরানহাটি, মনোহরশাহি, রেনেটি, মন্দারী, ঝাড়খন্ডী ঘরানার মধ্যে প্রথম তিনটিকে মূলত প্রাধান্য দেওয়া হয়। এক একটা ঘরের এক একটা স্বরূপ। কীর্তন বিভিন্ন ঘরের বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। তবে মূল বিষয় কিন্তু তিনটি। সুর, তাল আর গানের কথাই হল প্রধান। উচ্চাঙ্গসংগীতের মাধ্যমে বাকী পাঁচটি উপাঙ্গের প্রয়োগ থাকতে পারে। তারপর অন্যান্য সঙ্গীত যেমন, রবীন্দ্রনাথের কীর্তন, নজরুলের কীর্তন, লালনের গান কিংবা ভজনগীতও কীর্তন হতে পারে, তবে এগুলি অবশ্যই যেন কীর্তনাসরে একটা বড় তালের গান হয়। এর মধ্যে একটা পদাবলী গুরুমুখী ভাব অবশ্যই যেন থাকে, নইলে মিছে মিছে আসরে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু নয়। আজ থেকে দু'দশক আগেও গ্রামে কীর্তনের অনুষ্ঠান শুনেছি। বিখ্যাত সব শিল্পীদের গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। এখনও তেমন ভালো কীর্তন শিল্পী খুব কম আছে বলে মনে করি না। আধুনিকতার আগ্রাসনে তারা হয়তো একঘরে হয়ে গেছে। আবার কিছু কীর্তন শিল্পী আধুনিকতার আগ্রাসনে গা ভাসিয়ে কীর্তনকে প্রহসনেও পরিণত করেছেন, এটাও ঠিক। বহু ক্ষেত্রে কীর্তন ব্যবসার আঙ্গিক হয়ে গেছে। দুই তিন ঘন্টা গানের জন্য একটু নাম করা শিল্পীরা চল্লিশ, পঞ্চাশ হাজার টাকা করে নিচ্ছেন। এমনকি লক্ষাধিক টাকাও নিচ্ছেন। রক-ব্যাণ্ডের তালে 'কীর্তন'ও শুনতে হচ্ছে। তবে শুনছেও মানুষ। হয়তো 'কীর্তন' নয়, নামে তো 'কীর্তন'! ©রূপেশ সামন্ত। (১৪.০৪.২১)

Tuesday, 13 April 2021

Kumarpur Hateswar Jiu

হাজার হাজার নর-নারীর কামনা-বাসনা আজ যেথায় জলের ধারায় নিবেদিত হয়েছিল- হটেশ্বর জীউ, কুমরপুর, হাউর অঞ্চল, পাঁশকুড়া

'হারানো সুরে'র পথ ধরে গাজন তলায়- Gajan

'হারানো সুরে'র পথ ধরে গাজন তলায়... ✍️রূপেশ সামন্ত
'রথ দেখা, কলা বেচা'- প্রবাদ বাক্যটি নেহাতই প্রবাদ নয়, বাস্তবও। সেই চোট্ট বেলায় দেখেছি, গাজন শেষে বৈশাখী রথের মেলায় কলা বিক্রি করে দাদুরা ৫ পয়সার মিষ্টি -রথ কিনে দিচ্ছে নাতিদের। তখনকার সময়ে সিঙ্গাপুরি কলার প্রচলন হয়নি। কলা বলতে চাঁপা কলা, কাঁঠালি কলা আর বিচাকলাই ছিল। আর মেলায় বিক্রি হত পাকা বিচাকলা। তখনকার সময়ে গাজন মেলা পাকা বিচাকলায় ম ম করত। উপোষী রমনীরা শিবলিঙ্গে জল পাকা বিচাকলা কিনে নিয়ে বাড়ি যেত। ভেজানো সাবুদানার সাথে পাকা বিচাকলা, তরমুজ, পাটালি গুড় ইত্যাদি খেত। গাজন মেলায় গোলাকৃতির বড় বড় তরমুজ বিক্রি হত। এই তরমুজ গুলি মেলার পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলিতেই চাষিরা চাষ করত। সেই সব তরমুজের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। এখন সে সব তরমুজের দেখা মেলে না। এখন দেখা মেলে না পাকা বিচাকলারও। তখনকার সময়ে গাজন মেলায় বিক্রি হত পাকা বেল। গ্রীষ্মের দুপুরে পাকা বেলের সরবত ছিল অনন্য তৃষ্ণা নিবারক। গাজন তলার 'শিবের বেলগাছে' ঢিল ছুঁড়ে পাকা বেল পাড়ার মজাটাই আলাদা ছিল দুষ্টু ছেলেদের। এছাড়া বড় বড় সাইজের রাঙা আলু প্রচুর বিক্রি হত গাজন মেলায়। দিনের বেলায় রান্না শেষে মা-ঠাকুমারা রাঙা আলুকে উনুনের মরা আগুনে দিয়ে দিত। বিকালে ঘুম থেকে উঠে সেই পোড়া রাঙা আলু খাওয়ার স্বাদ আজও যাওয়ার নয়। পাকা সবেদা গাজন মেলার স্বাদটাই পালটে দিত। গাছ থেকে কাঁচা সবেদা পেড়ে ৩/৪ দিন কুঁড়ো বা খড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হত। এরপর পাকা সবেদা গুলো ভেঙে ভেঙে কোষ ছাড়িয়ে খাওয়া হত। হারিয়ে গেছে গাজন মেলার সেই দিন গুলি। এখন সেই ভাবে আর গাজন মেলাও হয় না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গতিময়তা, আধুনিক জীবন-যাপন, শপিংমল সংস্কৃতি মেলার উপযোগিতাকেই কমিয়ে দিয়েছে। যেখানে আজও টুকটাক মেলা হয়, সেখানে সেই আদি সংস্কৃতির জায়গায় স্থান নিয়েছে প্রসেসড ফুড, ফার্স্ট ফুড। হারিয়ে গেছে গাজন তলার সেই পাকা বিচাকলা, পাকা বেলের 'ম' 'ম' সুবাস! 'হারানো সুরে'র পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নাকে ভেসে আসে শুধু চিকেন 'মো' 'মো' সুবাস! ©রূপেশ সামন্ত

Saturday, 10 April 2021

এক অন্যরকম উৎসব- Mahaprabhu Shreechaitanya

এক অন্যরকম উৎসব ©রূপেশ সামন্ত চলছে মহোৎসব প্রস্তুতি। অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য! পাঁশকুড়া ব্লকের চৈতন্যপুর১ অঞ্চলের কালই তেলিপুকুর মাঠে মহাপ্রভুর হরিনাম সংকীর্তন ও মহামেলা সপ্তাহব্যাপী চলছে। সেই উপলক্ষে আজ মহোৎসব। গতকাল সারাদিন ধরে চলেছে অন্নপ্রসাদ প্রস্তুতি পর্ব। করোনা পরিস্থিতিতে কিছুটা ভাটা পড়লেও প্রায় ২০-২৫ হাজার মানুষ প্রসাদ গ্রহন করবেন।
ডাল, বিচাকলার ছেঁচড়া, কুমড়োর ঘন্ট, পটলের তরকারি, চাটনি ইত্যাদি থাকছে জনপ্রিয় মেনু হিসাবে। পার্শ্ববর্তী ৪০-৫০টি গ্রামের মানুষ একযোগে হাতে হাত লাগিয়ে এই 'মহাযজ্ঞ' সম্পন্ন করেন। নিজেদের ক্ষেতের চাল, কুমড়ো, পটল, আলু, বিচাকলা, টমেটো ইত্যাদি মহাপ্রভুর উদ্দেশ্যে দান করেন। এছাড়া বহু ভক্ত তেল, মশলা, জ্বালানি, অর্থ ইত্যাদি দিয়ে মহোৎসবে সাহায্য করেন। বাড়ির মেয়েরা আগের দিন থেকে বাড়ির বঁটি নিয়ে এসে সবজি কাটাকুটিতে সাহায্য করেন। ভক্তরা সপ্তাহব্যাপী সারাদিন সারারাত এখানে থেকে হরিনাম শুনে মেলার আনন্দ উপভোগ করে সময় অতিবাহিত করেন। এখানকার মানুষেরা এই দিনটির জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন। আজ মহোৎসবে চলে আসুন, প্রত্যক্ষ করুন এক অন্যরকম উৎসব।

তেলিপুকুর মাঠে মহাপ্রভুর মহোৎসব- Mahaprabhu Shreechaitanya

তেলিপুকুর মাঠে মহাপ্রভুর মহোৎসব ✍️রূপেশ সামন্ত ভাত, ডাল, বিচাকলার ছেঁচড়া, কুমড়ার ঘন্ট, পটলের তরকারি, চাটনি ছিল মহাপ্রসাদ। আয়োজন ছিল ২৫ হাজার মানুষের। এই মহাযজ্ঞে প্রসাদ বিতরণ করেছিল নারী বাহিনী। সহযোগী ছিল পুরুষরা। সুশৃঙ্খল ভাবে হাজার হাজার মানুষ প্রসাদ গ্রহন করেছে। একই সঙ্গে চলছে মহানাম যজ্ঞ। হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ ভক্তিভরে শুনছে নামগান। সপ্তাহব্যাপী 'মহা মহা মহানাম যজ্ঞে'র আজ ছিল শেষ দিন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ৪০-৫০টি গ্রামের মানুষ পাঁশকুড়ার চৈতন্যপুর-১ অঞ্চলের কালই গ্রামের তেলিপুকুর মাঠে এই মহোৎসব ও মহানাম যজ্ঞ করে। এই অনুষ্ঠানে সর্বধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ যোগদান করে সম্প্রীতির মহামিলন ক্ষেত্র গড়ে তুলে। সর্বোপরি নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিনরাত এক করে এই মহা অনুষ্ঠান যেভাবে সম্পন্ন করে, তা শিক্ষনীয়। আমাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সত্যিই গর্বের। ©রূপেশ সামন্ত

Friday, 9 April 2021

গঙ্গামাড়ো তলার গঙ্গার বিগ্রহই হল গঙ্গার একমাত্র প্রাচীন দারুবিগ্রহ- Ganga

গঙ্গামাড়ো তলার গঙ্গার বিগ্রহই হল গঙ্গার একমাত্র প্রাচীন দারুবিগ্রহ ©রূপেশ সামন্ত
হাজারো মানুষের ভীড়ে ছাপিয়ে যায় পলাশপাই নদীর দু’কুল। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর-২ ব্লকের গৌরার গঙ্গামাড়ো তলার গঙ্গাপূজা ও বারুনী স্নান নিয়ে জড়িয়ে আছে বহু লোককথা ও ইতিহাস। উৎসবের সময়টা হল চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী। এই সময় গঙ্গাপূজা উপলক্ষ্যে সপ্তাহ ব্যাপী চলে বিরাট মেলা। প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন মেলায় আজও দূর-দুরান্তের বহু ধর্মপ্রাণ মানুষের সমাগমই প্রমান করে তার সূদুরপ্রসারী মাহাত্ম্য। মেলাটি গঙ্গা-বারুনি মেলা নামে পরিচিত। আসলে মেলার কেন্দ্রে রয়েছে প্রাচীন গঙ্গাদেবী ও তাঁর মাহাত্ম্য। এই দেবীকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে টান-টান উত্তেজনাপূর্ণ এক লোককথা। গৌরার এই গঙ্গা মন্দিরের স্থানটি গঙ্গামাড়ো তলা নামে পরিচিত। প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে পলাশপাইয়ের তীরের এই স্থানটি ছিল শ্মশান। চারিদিকে ছিল ঘন জঙ্গল। একদিন এক শাঁখারী শাঁখা বিক্রি করছিল এই এলাকায়। একটি মেয়ে এসে শাঁখারীর কাছে একজোড়া শাঁখা কিনল। শাঁখারী শাঁখার মূল্য চাইলে মেয়েটি বলে, “আমার বাবার নাম রামকিশোর প্রামানিক। আমি এখন নদীতে স্নান করতে যাচ্ছি। বাবার কাছে শাঁখার মূল্য নিয়ে নেবে। টাকা বাড়ির কুলুঙ্গিতে রাখা আছে”। রামকিশোর প্রামানিক ছিলেন এই এলাকার একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং নিঃসন্তান। শাঁখারী মেয়েটির কথামতো রামকিশোর বাবুর বাড়িতে উপস্থিত হলেন এবং শাঁখার মূল্য চাইলেন। তখন রামকিশোর বাবু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং বললেন, “আমার কোন কন্যাসন্তান নেই। আমার সঙ্গে প্রতারনা করতে এসেছো”? শাঁখারী হতাশ হলেন। এরপর কৌতুহলভরে রামকিশোর বাবু মেয়েটিকে দেখতে চাইলেন। শাঁখারী তাঁকে পলাশপাই নদীর তীরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। রামকিশোর বাবু শাঁখারীকে ভৎর্সনা করলেন। শাঁখারী ক্ষমা চাইলেন। এমন সময় নদীঘাট থেকে হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শুনতে পেলেন। নদীর দিকে তাকিয়ে দুজনেই বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে গেলেন। অসীম জ্যোতিতে নদীর জল থেকে উপরে উঠে এসেছে এক নারীর দুটি দণ্ডায়মান হাত। সেই হাতে পরিধান করা রয়েছে শাঁখারীর সেই দুটি শাঁখা। নারীকণ্ঠে উচ্চারিত হল, ‘বাবা, আমি গঙ্গা। তোমার মেয়ে। আমিই শাঁখা কিনেছি। বাড়ির কুলুঙ্গিতে টাকা রাখা রয়েছে। শাঁখারীকে দিয়ে দিও’। তারপর নিমেষেই সব অদৃশ্য হয়ে গেল। রামকিশোর বাবু ছুটলেন বাড়িতে। দেখলেন কুলুঙ্গিতে সত্যিই শাঁখার মূল্য রয়েছে। রামকিশোর বাবু নিজে কখনোই এইভাবে কুলুঙ্গিতে টাকা রাখেন না। এই অলৌকিক কাণ্ডে তিনি বাহ্যত বিমূঢ় হয়ে গেলেন। পরে সেই মূল্য তিনি শাঁখারীকে দিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় রামকিশোর বাবু বিহ্বল হয়ে রইলেন। সেই রাতে স্বপ্নাদিষ্ট হলেন যে, গঙ্গা তাঁর কন্যরূপে এখানে অধিষ্ঠ হতে চান এবং ভোরের বেলা পলাশপাইয়ের জলে গঙ্গা ভেসে আসবেন। রামকিশোর বাবু ভোরবেলা ছুটলেন পলাশপাইয়ের তীরে। পলাশপাইয়ের জলে ভেসে এল এক নিমকাঠের দারুবিগ্রহ। সেই দারুবিগ্রহটি ছিল মকরের উপর দণ্ডায়মান গঙ্গার বিগ্রহ। রামকিশোর বাবু সেই বিগ্রহ পলাশপাইয়ের তীরে প্রতিষ্ঠা করলেন। পরে পঞ্চরত্ন মন্দির স্থাপন করলেন। গঙ্গার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার দিনটি ছিল মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী। সেই থেকে প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে উদযাপিত হয় গঙ্গার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও বারুনী স্নান পর্ব। এখানে বিবাহিত মহিলারা স্বামীর মঙ্গল কামনায় নতুন শাঁখা পরে পলাশপাইয়ের জলে ‘বারুনী স্নান’ করে। আর বসে বিরাট মেলা। চৈত্র মাসকে মধুমাস বলাহয়। তাই চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীকে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী বলা হয়। এই চৈত্র বা মধু মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে শতভিষা নক্ষত্রের যোগ হলে, তাকে বারুণী তিথি বলে। শতভিষা নক্ষত্রের আরেক নাম বরুণ। শতভিষা নক্ষত্র তথা বরুণ নক্ষত্রের নামানুসারে এই যোগকে বারুণীযোগ বলা হয়। এই সময় গঙ্গাস্নানে বহুশত সূর্যগ্রহন জনিত গঙ্গাস্নানের সমান ফল লাভ হয়। বারুণী হল গঙ্গা স্নানের একটি বিশেষ যোগ। গঙ্গামাড়ো তলার পলাশপাই নদীটি পূন্যার্থীদের কাছে গঙ্গারই প্রতিরূপ। তাই মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তথা বারুনী তিথিতে এখানে গঙ্গাপূজা উপলক্ষ্যে পূন্যার্থীরা মনস্কামনা পূরণে বারুনী স্নান করে। সেই উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয় বিরাট মেলা। গঙ্গার প্রাচীন ‘পঞ্চরত্ন’ মন্দিরটি এখন আর নেই। কালের গর্ভে ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই প্রাচীন মন্দিরের ফলকে লেখা ছিল, ‘সন ১১/৮৭ সাল/ বিস্তিথ ২১/ আঘ্রান’। সুতরাং ফলক অনুসারে প্রাচীন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে। বর্তমানে নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে রামকিশোর প্রামানিকের স্মৃতি ফলক। মন্দিরে প্রাচীন দারুবিগ্রহটিই রয়েছে। দারুবিগ্রহটি নিমকাঠের তৈরি। মন্দিরের পুরোহিত শক্তিশংকর চক্রবর্তীর মতে, এই বিগ্রহটি রামকিশোর প্রামানিক প্রতিষ্ঠিত সেই প্রাচীন দারুবিগ্রহ। তবে দারুবিগ্রহটি যে খুবই প্রাচীন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বহু বছর অন্তর বিগ্রহের ‘অঙ্গরাগ’ হয়। এই অঙ্গরাগের মধ্য দিয়ে বিগ্রহটিকে নবরূপে সজ্জিত করা হয়। যতদূর জানা যায়, গঙ্গার এইরূপ দারুবিগ্রহ পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও নেই। গঙ্গার অদ্বিতীয় দারুবিগ্রহের সাথে অনন্য মাহাত্ম্য গঙ্গামাড়ো তলার গঙ্গাকে করে তুলেছে পূন্যার্থীদের গন্তব্যের অন্যতম কেন্দ্র।

জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল?

  জীবনের ভুল — সত্যিই ভুল? জীবন এক অমোঘ প্রবাহ—সময়ের স্রোতে আমাদের চিন্তা, অনুভব ও সিদ্ধান্ত সবই পরিবর্তিত হয়। আজ যা ভুল মনে হয়, কাল তা সঠি...